মেলার হাতিঘোড়া আকৃতির মিষ্টি তৈরি করেন যারা

বগুড়া প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৬

বগুড়ার গ্রাম কিংবা শহর, যেকোনো স্থানে বসা মেলাতে গেলেই চোখে পড়ে চিনি দিয়ে বানানো হাতিঘোড়া ফুলসহ বিভিন্ন আকৃতির মিষ্টি খাবার। এছাড়া রসুনের মতো দেখতে সাদা ডোরাকাটা কদমা। মেলা ঘুরে বাড়ি ফেরার সময় অধিকাংশ দর্শনার্থীদের হাতের ব্যাগে ঠাঁই পায় ছাঁচ, কদমা, খাগড়াই বাতাসা। মিষ্টান্ন জাতীয় এই খাবারগুলোর বগুড়া সদর উপজেলার সদরের নুনগোলা ইউনিয়নে হরিপুর কারিগরপাড়ায় বানানো হয়। এখানকার উৎপাদিত খাবারগুলোই পুরো জেলায় সরবরাহ করা হয়।

৩০ বছর আগে রঞ্জিত চন্দ্র দাস নামের একজন কারিগরের মাধ্যমে এসব মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার তৈরির কর্মযজ্ঞ শুরু হয় গ্রামটিতে। পরবর্তীতে রঞ্জিতের আত্মীয়-স্বজন মিলে ১৬ জন অংশীদার হিসেবে অর্থলগ্নি করে ব্যবসা পরিচালনা শুরু করেন। তারা প্রত্যেকে নিজেরাই কারিগর, আবার নিজেরাই প্রতিষ্ঠানের মালিক। ১৬ জনের মধ্যে কেউ চিনি জ্বাল দেয়ার কাজ করেন। কেউ কেউ গরম শিরা দিয়ে কাঠের ফ্রেমে হাতি-ঘোড়া, মাছ ও রকমারি ফুলের আকৃতির ছাঁচ তৈরি করেন। আবার কয়েকজন করেন কদমা। কারো দায়িত্ব থাকে খাগড়াই বানানোর। বাংলা সনের আশ্বিন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এভাবেই কারখানায় এসব মিষ্টান্ন উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ চলে। তবে বর্ষাকাল থেকে বৃষ্টিপাত হয় এমন চার মাস বন্ধ থাকে কারখানা। এই সময়টায় তারা অন্য পেশায় নিয়োজিত হন। কর্মযজ্ঞ চলাকালীন সময় সাধারণত কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ১০ মণ কদমা, ১০ মণ ছাঁচ ও ৫ মণ খাগড়াই বানানো হয়। তবে এখন বৈশাখি মেলা উপলক্ষ্যে এর পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে দৈনিক ৫০ কেজি ওজনের ১০ বস্তা চিনির মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়, বৈশাখকে কেন্দ্র করে এখন প্রতিদিন অন্তত ২০ বস্তা চিনির মিঠাই সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে।

তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে কারিগরা জানান, মিষ্টান্ন এই খাবারগুলো উৎপাদনের একমাত্র উপাদান চিনি। কড়াইয়ে গরম পানিতে চিনি ঢেলে জ্বাল দিয়ে শিরা করেন কারিগররা। পরে সেগুলো কাঠির সঙ্গে টেনে টেনে খামির তৈরি করা হয়। এরপর সুতায় কেটে প্রস্তুত হয় গোলগোল কদমা। আর মাছ, হাতি, ঘোড়ার জন্য ব্যবহার হয় কাঠের ছাঁচ। এ জন্য এগুলোর নামও চিনির ছাঁচ।

তপন কুমার দাস নামের এক কারিগর বলেন, এক কড়াই গরম পানিতে ১০ কেজি চিনি দেয়া হয়। জ্বাল দেয়ার পর সেখান থেকে ২০০ গ্রাম কমে যায়। ৮০০ গ্রাম কদম, ছাঁচ পাওয়া যায়। জ্বাল দেয়া শিরাকে ঢালাই করা পাটাতনে রেখে দেয়া হয়। সেগুলো একটু ঠান্ডা হয়ে এলে হাতে বিশেষ পদ্ধতিতে টেনে লই বা খামির বানানো হয়।

কোকিল চন্দ্র দাস বলেন, চিনির লই বানানোর পর হালকা গরম থাকতেই এটাকে কেটে কদমা তৈরি হয়। ঠান্ডা হয়ে গেলে আর কিছু বানানো যায় না।

সুজন চন্দ্র দাস নামের আরেকজন জানান, হরিপুরের এসব মিঠাই বগুড়ার সব উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। বগুড়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলার যেকোনো ধরনের মেলার জন্য ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে থেকে ক্রয় করে নিয়ে যায়। আশ্বিন মাসের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে মেলা শুরু হয়। তখন থেকে তাদের কাজের মৌসুম। একেবারে চলে জ্যেষ্ঠ মাস পর্যন্ত। এরপর তারা হিসাবনিকাশ করে মুনাফা ভাগাভাগি করেন। এতে প্রতি বছর গড়ে একেকজন প্রায় তিন লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন।

উত্তম চন্দ্র দাস নামে এক কারিগর জানান, আমরা সকাল ৭টা থেকে শুরু করি। রাত ১০টায় কাজ শেষ হয়। এর মধ্যে যার যার বাড়ি গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিই। বছর শেষে আমরা ১৬ জন টাকা ভাগ করে নিই। আমরা ইতোমধ্যে দেড় লাখ করে টাকা পেয়েছি। এখন যেমন অবস্থা দেখছি, তাতে আশা করছি বৈশাখ শেষে সবমিলে তিন লাখ টাকা আয় হবে।

শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থানগড় এলাকার মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম জানান, মহাস্থানহাট এলাকায় তার মিষ্টির দোকান আছে। এজন্য তিনি প্রায় ১০-১২ বছর ধরে হরিপুর গ্রাম থেকে এসব মিষ্টান্ন কেনেন। পরে সেগুলো নিয়ে তার দোকানে বিক্রি করেন। এছাড়া যখন যেখানে মেলা বসে সেই মেলায় গিয়ে তিনি মিষ্টির পসরা নিয়ে বসেন।

রঞ্জিত চন্দ্র দাস জানান, আগে তারা ঝুড়ি, মুড়কি, মোয়া বানিয়ে বিক্রি করতেন। ওই সময় ওগুলো তেমন চলতো না। পরে ১৯৯২ সালের দিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে কদমা, বাতাসা ক্রয়ে করে আনা শুরু করেন। চাহিদা ভালো থাকায় এর দু বছর নিজে তৈরি করার উদ্যোগ নেন। তারপর থেকে চলছে কদমা-খাগড়াইয়ের উৎপাদন। এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ মণ কদমা, ১০ মণ ছাঁচ ও ৫ মণ খাগড়াই বানানো হচ্ছে।

রঞ্জিত চন্দ্র দাস বলেন, সে সময় লাভের পরিমাণটা ভালো থাকায় সে সময় এই ব্যবসা শুরু করেছিলাম। প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেল। এখন অনেক স্থান থেকে মাল ক্রয় করতে আসে। অনেকে চেনে। এই কদম, খাগড়াই তৈরি থেকে আয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাচ্ছেন। বড় ছেলে বিএ (সম্মান) পড়ছেন। মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে বলে জানান রঞ্জিত। তবে অনেক পরিশ্রমের কাজ হওয়ায় তিনি চাননা এই পেশায় তারা আসুক।

(ঢাকা টাইমস/১৭এপ্রিল/প্রতিনিধি/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :