প্রকৃতির মাঝে দৃষ্টিনন্দন শীতল সবুজ এক কারখানা

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪৬
অ- অ+

সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। দ্রুত নগরায়ন ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতিতে তীব্র গরম মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে নাভিশ্বাস ওঠা দাবদাহকে। শুধু মানুষই নয় পুরো জীবজগতকেই এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সভ্যতার রথে চড়ে আমরা যেন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবুজ আলপনাকে সজ্ঞানে নষ্ট করে চলেছি। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রকৃতিও তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে আমাদের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠছে। তীব্র গরমে ছায়া সুশীতল বাতাসের পরশে শরীরকে শীতল করার জন্য সবুজ গাছপালার কোনো বিকল্প নেই।

সবুজ গাছপালা যেমন ছায়া দিয়ে আমাদের স্বস্তি দেয় তেমনই তাদের জৈবিক কাজের অংশ হিসেবে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শীতল বাতাস দেয়, যাকে ইভাপোট্রান্সপিরেশন বা বাষ্পীয়-প্রস্বেদন বলা হয়। প্রস্বেদন এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে গাছ এবং গাছপালা তাদের শিকড় দ্বারা শোষিত পানি সবুজ পাতার মাধ্যমে জলীয় বাষ্প বাতাসে ছেড়ে দিয়ে পরিবেশকে শীতল রাখে। একই সাথে ছেড়ে দেওয়া জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে পৃথিবীকে শীতল রাখে।তাই সবুজ গাছপালা বৃদ্ধি করে ইভাপোট্রান্সপিরেশনের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের তাপ শোষণ করে বাতাসকে ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। দাবদাহ বা হিট ওয়েভ মোকাবিলার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি সবুজ পরিকল্পনা। হিট ওয়েভ মোকাবিলায় এ মুহূর্তে সবুজ পরিকল্পনায় এগিয়ে এসেছে অনেক প্রতিষ্ঠান, কারখানা। তেমনই একটি দৃষ্টিনন্দন প্রতিষ্ঠান রংপুর কারুপণ্য লিমিটেড যেন শীতলের সবুজ কারখানা।

গেট দিয়ে ঢুকলে আট লাখ বর্গফুটের বিশাল কারখানার চৌহদ্দি। মাঝখানে সাততলা কারখানা ভবন দেখলে একটা বিশাল সবুজ বাগান বললে ভুল হবে না। নানা প্রজাতির গাছে ছেয়ে আছে ইট-পাথরের দালান। সাততলা ভবনের ওপর থেকে দেয়ালজুড়ে ঝুলছে লতাপাতার গাছ। ভবনের সামনেও গাছগাছালি। দক্ষিণের বাতাস এসে গাছে দোল খায়।

সাততলা বিশাল এক কারখানা যার আয়তন তিন লাখ বর্গফুট। ৪০ হাজার বর্গফুট ছড়ানো এক–একটি ফ্লোর। দিনে-রাতে দুই শিফটে এখানে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। পুরো কারখানায় একটি এসিও নেই, নেই কোনো বৈদ্যুতিক পাখা। অথচ অস্বস্তিকর গরমের দিনেও কোনো শ্রমিক এখানে কাজ করার সময় ঘামেন না। কেননা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে কারখানার ভেতরটা কয়েক ডিগ্রি শীতল।

রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জে স্থাপিত কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের এই কারখানার ভবন শীতল রাখা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের স্থাপত্যকৌশল প্রয়োগ করে। এতে কারখানাটির ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনে একটি সবুজ (গ্রিন) কারখানা গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য।

কারুপণ্যের এই বিশাল কারখানায় যা তৈরি হয়, তার নাম শতরঞ্জি। এটি রংপুর অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্য। একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই শিল্প আবার জেগে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে হাতে গোনা কয়েকজন পুরোনো কারিগরকে সংগঠিত করে নতুন করে এর যাত্রা শুরু করা হয়। ২৮ বছরের দীর্ঘ সময়ে কাঁচামাল, বুনন ও নকশায় নানা পর্যায় পেরিয়ে রংপুরের শতরঞ্জি আজ রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের ৫৫টি দেশে। গত অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ৩ কোটি ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশে হস্তশিল্প রপ্তানি বাণিজ্যে শিল্প খাতে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে কারুপণ্য। সে জন্য প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে।

এই শতরঞ্জি তৈরির পেছনেও কারখানায় ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক ও নবায়নকৃত কাঁচামাল। বছরে ৩ হাজার টন কটন মিলের তুলার বর্জ্য থেকে তৈরি হয় সুতা। তা ছাড়া ১ হাজার ২০০ টন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির বর্জ্য ঝুট কাপড় এবং সাড়ে ৪ হাজার টন পাটের আঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে এই কারখানায়। বর্জ্য নবায়ন করে পণ্য প্রস্তুত করার ফলে দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি।

রংপুর অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্যের শতরঞ্জি কার্পেটের মতো দেখতে হলেও, এটি কার্পেটের মতো ভারী নয়। বাঁশ এবং রশি দিয়ে ছোট বা বড় চরকার মাধ্যমে সুতা টানা দিয়ে গ্রামের বুনন শিল্পীরা খুব যত্নের সাহায্যে শতরঞ্জি তৈরি করেন। এসব শতরঞ্জি দেশ-বিদেশের ক্রেতার নজর কেড়েছে। বসার ঘরের মেঝে, শোবার ঘর, শিশুর ঘরের মেঝেতে এসব শতরঞ্জি রাখা যায়। খাবার টেবিলের ওপরও টেবিল ম্যাট ও রানারের মতো করে শতরঞ্জি বিছানো যায়। ওয়ালম্যাট, জায়নামাজ, পাপোশ হিসেবেও ব্যবহূত হয় শতরঞ্জি।

শতরঞ্জির পাশাপাশি দেশের অন্যান্য হস্তশিল্পও রয়েছে এই কারখানায়। সুবিশাল শোরুমে মধ্যে পাট, বাঁশ, কাশিয়া, লোহা লক্কড় ও কচুরিপানাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া কাঁচামাল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করেন। যা দেখে মুগ্ধ হন উপস্থিত দর্শকরা। এসব পণ্য দেশীয় বাজারের পাশাপাশি অনেকদিন থেকেই স্থান করে নিয়েছে ইউরোপের বাজার।

কারখানার স্থাপত্য নকশায় এমন বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে কারখানার ভেতরে বাতাস প্রবাহিত হয়। নিচতলায় লবিতে পুকুরের মতো বড় বড় চারটি জলাধার। ১৫ হাজার বর্গফুট ব্যাসার্ধের এ জলাধারগুলো একসঙ্গে ধারণ করতে পারে ৫ লাখ লিটার পানি। আয়রনমুক্ত এই পানি কারখানায় শতরঞ্জি ডাইংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়ে এই জলাধারে আসে।

সবুজ গাছপালা আর এই পানির ওপর দিয়ে উড়ে আসা বাতাস ৩৭ ফুট ব্যাসার্ধের চারটি চক্রাকার শূন্য স্তম্ভের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কারখানার ভেতরে। তারপর বিভিন্ন তলায় উঠে যায়। ফলে এসি বা ফ্যান ছাড়াই কারখানার বাইরের চেয়ে ভেতরের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়।

ভবনের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে সূর্যের আলো এসে পড়ে। সূর্যের তাপ কারখানার দেয়ালে পড়ে এর প্রভাব যেন ভেতরে না যায় এ জন্য ভবনের প্রতি তলায় সাড়ে চার ফুট দূরত্ব রেখে বারান্দা ও জানালা রয়েছে। সেই সঙ্গে বাইরে দেয়ালজুড়ে লাগানো হয়েছে সবুজ লতাপাতা গাছ। এ কারণে রোদের তাপ ভেতরে ঢুকতে পারে না।

এ ছাড়া কারখানার দক্ষিণে সবুজ গাছগাছালি লাগানো রয়েছে। এই গাছে এসে দক্ষিণের গরম বাতাস বাধা পায়। ঘুরপাক খেতে খেতে কারখানার দেয়ালে গিয়ে গরম হাওয়া আরও শীতল হয়ে যায়।

ভবনের দেয়াল ও সামনে দেড় লাখের মতো নানা প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। কোনো সারিবদ্ধভাবে গাছ নেই। এলোমেলোভাবে গাছগুলো রয়েছে। কোথাও ছোট, আবার কোথাও কিছুটা বড়। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে ভবন দেখতে হয়। কিছু বাঁশঝাড়ও রয়েছে। গাছের নিচে বসলে যেমন একটু ঠান্ডা অনুভূত হয়। বিভিন্ন ভিজ্যুয়াল আর্টের সঙ্গে কারখানার ভেতরে গ্রামীণ পরিবেশের আবহ তুলে ধরা হয়েছে। ফলে পুরো পরিবেশ হয়েছে উঠেছে আরও শীতল ও ছায়াঘেরা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

(ঢাকাটাইমস/২৭ এপ্রিল/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এক মোটরসাইকেলে যাচ্ছিল ৪ বন্ধু, ট্রাক চাপায় প্রাণ গেল দুজনের
ভারতের সামরিক অভিযানের দ্রুত, দৃঢ় ও কঠোর জবাব দেওয়া হবে: পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
সুনামগঞ্জে কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয় ৯০টি গরুসহ নৌকা জব্দ 
সাবেক আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরীর ইন্তেকাল 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা