ধোলাইখালের রাস্তা যখন গরুর হাট

কোরবানির ঈদের আর মাত্র বাকি ৫দিন। রাজধানীতে অস্থায়ীভাবে বসেছে পশুর হাট। বিভিন্ন জেলা এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে হাটে আসতে শুরু করেছে কোরবানির পশু। রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে অনুমতি ছাড়াই সড়কের ওপর বসেছে কুরবানির পশুর হাট। প্রধান সড়কের অর্ধের বেশি জায়গা জুড়ে গরুর অবৈধ হাট বসায় ইতোমধ্যে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে নগরীর বেশকিছু এলাকায়।
সরেজমিনে ধোলাইখাল এবং শনির আখড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর এই দুই এলাকার প্রধান সড়কজুড়ে অবৈধভাবে বসেছে গরুর হাট। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যাপারীরা গরু নিয়ে এলে রাস্তার মধ্যেই গরু নামানো হচ্ছে গরু। পাশাপাশি রাস্তার দুই পাশে অস্থায়ী খুঁটিতে বেঁধে রেখে চলছে বেচা-কেনা।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকা থেকে ধোলাইখাল যেতে প্রথমেই চোখে পড়ে প্রধান সড়কের ওপর ইজারাদার আসফাক আজিম নামের বিশাল গরু ছাগলের হাটের একটি তোরণ। একটু সামনে যেতেই দেখা যায় প্রধান সড়কের দুই পাশে এবং মাঝখানে সারিবদ্ধভাবে গরু রাখা হয়েছে।
দয়াগঞ্জের এই সড়কে অন্যান্য দিনের তুলনায় যানজট ছিল চোখে পড়ার মতো। ফলে অসহনীয় গরমে যানজটে নাকাল হয়ে পড়ছেন এই পথে যাতায়াতকারী যাত্রীরা।
বেশ কয়েকটি পরিবহনের চালকদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, এই সড়কে মাঝে মধ্যে যানজট থাকে, তবে তা দীর্ঘ সময় ধরে নয়। কিন্তু বর্তমানে রাস্তার মধ্যে গরুর হাট বসায় সড়কের অর্ধেকের বেশি জায়গা গরুর হাট দখল করে নিয়েছে। এজন্য যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। দয়াগঞ্জ থেকে সদরঘাট এলাকায় যেতে সময় লাগছে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা।
মাদারীপুর থেকে গরু নিয়ে আসা ব্যাপারী আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘মাদারীপুর থেকে আমরা ২০টা গরু নিয়া আইছি। আমরা তো জানি না কোথায় গরু রাখতে হবে। হাটের লোকজন আমাদের দয়াগঞ্জের এই মেইন রাস্তার ওপরেই গরু রাখতে বলছে, তাই রাখছি। আমরা চাই না রাস্তা বন্ধ কইরা গরু রাখতে। আর এইখানে গরু রাখতে পুলিশ প্রশাসন কেউই আমাগো কোনো সমস্যা করছে না।’
রিকশাযোগে সদরঘাট যাচ্ছিলেন যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মারুফ হোসেন। ধোলাইখালের সড়কে যানজটে পড়েন। কিছুক্ষণ পর তিনি রিকশা থেকে নেমে দেখতে পান প্রশস্ত রাস্তা যেন সরু হয়ে গেছে। রাস্তায় বাঁশ গেড়ে সেখানে গরু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মারুফের সঙ্গে ঢাকা টাইমসের কথা হলে তিনি বলেন, ‘দেখেন রাস্তাজুড়ে গরু ছাগলের হাট বসছে। এটা নাকি আমাদের ডিজিটাল দেশ। ধোলাইখালের এই রাস্তা এখন গরুর হাট। আমাদের চাইতে গরুর কদরই এহন বেশি মনে হয়।’
চুয়াডাঙ্গা থেকে ২৩টি গরু নিয়ে আসা নুরু মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গরুগুলা নিয়া ঢাকায় আইতে অনেক সময় লাগছে। কাইলকা (সোমবার) দুপুরে রওনা দিছি।
খাওয়া-দাওয়া নেই, ঘুমও নেই। ভোরে গরু নিয়ে ধোলাইখাল নামছি। এইহানের লোকজন আমাগো রাস্তায় গরু রাখতে কইছে। তারা রাস্তার অর্ধেক নাকি সরকারের থেইকা লিজ নিছে। তাই রাস্তার দুইপাশের অর্ধেক বাশ দিয়া গরু রাখার জায়গা কইরা দিছে। এইহানে আমাগো গরু রাখতে কোনো সমস্যা নাই। তয় রাস্তায় সকাল থেইকা জাম লাইগা আছে। এইডাতো আর আমাগো দোষ না।’
ধোলাইখাল এলাকার সড়কগুলোতে দেখা যায় সড়কের দুপাশ জুড়েই বাঁশ দিয়ে গরু রাখার জায়গা করা হয়েছে। এছাড়াও বাঁশের ওপর ত্রিপল দিয়ে ছাউনিও দেওয়া হয়েছে। গরু রাখায় ময়লার ভাগারে পরিণত হয়েছে সড়কের বাকি অংশ। এছাড়াও সড়কের দুপাশের হাঁটাচলার ফুটপাতও দখল করে রাখা হয়েছে গোখাদ্য রেখে। ফুটপাতে দখল করে অনেক ব্যাপারীরা আবার রাত্রিযাপনের স্থানও বানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সূত্রাপুর থানার ওসি (অপারেশন) বাইতুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ধোলাইখালের রাস্তার ওপরেই হাট হয়। আর তো কোনো জায়গা নেই। তবে আমি নতুন এসেছি। ইজারা কোথায় দিয়েছে সেটা জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ওয়ারী থানার ওসি জানে আলম মুন্সি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ধোলাইখালের সড়কের একপাশ ওয়ারী থানার আওতাধীন পড়েছে। ওয়ারী থানার মধ্যে কোনো গরুর হাটের অনুমতি নেই। যদি কেউ গরুর হাট বসায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দয়াগঞ্জ এলাকার ৪০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কালাম আজাদের মোঠোফোনে কল দিলে তার ছোট ভাই পরিচয় দেওয়া রানা ঢাকা টাইমকে বলেন, ‘রাস্তার ওপরই হাট বসে আসছে। গরুর হাট বসার আর কোনো জায়গা নেই। আপনি ইজারাদারের সঙ্গে কথা বলুন।’
ডিএমপির কোতোয়ালী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ইজারায় গরুর হাট বসানোর স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তার বাইরে যদি গরুর হাট বসে তাহলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে গেন্ডারিয়া থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ধোলাইখালের হাটটি রায়সা বাজার হয়ে খোকা মাঠে বসার কথা। হাটের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় রাস্তার ওপর বসানো হয়েছে। সব জায়গাতেই রাস্তায় হাট বসে এটা কোনো বিষয় না। রাস্তা ছাড়া তো গরুর হাট বসার আর কোনো জায়গা নেই।’
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাজধানীর সড়কে কোনো ধরনের গরু থাকতে পারবে না। সড়কে কোনো হাট বসানো যাবে না। যদি কেউ বসায় তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ডিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনার স্পষ্ট বলে দিয়েছেন— রাজধানীর কোনো সড়কে গরুর হাট বসানো যাবে না। যদি কেউ বসায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
‘ধোলাইখাল, দয়াগঞ্জ ও রায়সা বাজার এলাকার প্রধান সড়কের ওপর গরুর হাট বসানো হয়েছে এবং সেখানে ওয়ারী, সূত্রাপুর এবং গেন্ডারিয়া থানা পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে’— এ বিষয়ে ডিএমপি কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কমিশনার সব থানাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। যদি কেউ দায়িত্ব অবহেলা করেন তাহলে ব্যবসস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সড়কে গরু রাখা বা হাট বসানোর কোনো অনুমতি নেই। আমরা কিছু কিছু জায়গার বিষয়ে জেনেছি। ইতোমধ্যে আফতাবনগর গরুর হাট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ধোলাইখালে যদি রাস্তার ওপর গরুর হাট বসে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্রাপুরের ৪২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই দেখে আসছি ধোলাইখাল এলাকায় গরুর হাট বসে। এইখানে জায়গা কম থাকার কারণে হাটটা রাস্তায় বসছে। তবে আমরা বারবারই বলে আসছি রাস্তায় যেন গরু রাখা না হয়। আসলে আমাদের মধ্যেই দুর্নীতি অনিয়ম, ব্যবস্থা নেবে কে।’ রায়সা বাজার থেকে শুরু হয়ে ধোলাইখাল এবং দয়াগঞ্জ পর্যন্ত পুরো সড়ক এখন ধোলাইখালের গরুর হাট। অথচ সিটি কর্পোরেশন উল্লেখ করেছিল ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকায় বসবে গরুর হাট। কিন্তু ইজারাদাররা প্রধান সড়ককেই উন্মুক্ত স্থান হিসেবে দখল করে নিয়েছে। সড়কের দুই পাশে বাঁশ দিয়ে ছাউনি করা হয়েছে। এছাড়াও সড়কের মাঝখানেও রাখা হয়েছে কোরবানির গরু।
ধোলাইখাল হাটের ইজারাদার আসফাক আজিম। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকবার মুঠোফোনে কল কলা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সরেজমিনেও গিয়েও তাকে গরুর হাটে পাওয়া যায়নি।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নির্ধারিত জায়গার বাইরে আশপাশের এলাকা বা সড়কে কোনো পশু রাখলে সংশ্লিষ্ট ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পশুর হাটকে কেন্দ্র করে যেন যানজট সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/১২জুন/এইচএম/এসআইএস)

মন্তব্য করুন