বর্ষাকালে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায়

বর্ষাকাল চলছে। ঋতু অনুযায়ী আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। প্রকৃতি ঠান্ডা হলেও বৃষ্টির প্রকোপে জনজীবনে এসেছে নানা পরিবর্তন। ঋতু পরিবর্তনকে নিজের শারীরবৃত্তীয় চক্রে খাপ খাইয়ে নিতে একটু সময় লাগে। তাই এই সময়েই অসুখ ঢুকে পড়ে ঢিলেঢালা সুরক্ষার ফাঁক গলে। তাই সচেতন হওয়ার সেরা সময় এটাই। বর্ষাকে কবজা করতে কিছু সাধারণ নিয়ম মানাই যথেষ্ট বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। তাদের মতে, বর্ষায় শরীরের ‘প্রোটেকটিভ মেকানিজম’ অর্থাৎ শরীরের নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থাকে ঠিক রাখতে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি। বিশেষ করে বর্ষায় অসুখ ও হাঁচি-কাশির সমস্যা হয়। তাই এই বর্ষায় সার্বিকভাবে সুস্থ থাকার উপায় মেনে চললে সুস্থ থাকা যায়।
বর্ষার সময় সব চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে জীবাণুরা। এ সময়ে অনেকেই ভাজাভুজির দিকে বেশি ঝুঁকেছেন। কিংবা একটু বৃষ্টি হলেই হাতের মুঠোফোনে খাবার ডেলিভারির অ্যাপে রেস্তরাঁয় খাবার অর্ডার করে ফেলছেন। তাই সাবধানে থাকার পাশাপাশি খাবার নির্বাচনেও হতে হবে সচেতন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই সময় কয়েকটি খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো।
বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা দেয়। এ সময় ডেঙ্গু যেন না ছড়ায় সে জন্য বাসার আশপাশে যেসব জলাধার বা পানি জমে এমন পাত্র সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ঘরের দেয়ালে যেন পানি পড়ে ফাঙ্গাস না জন্মায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘর যাতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এ থেকে রোগবালাই হয় বেশি। বর্ষায় পোকামাকড়, সাপ ও জোঁকের উৎপাত বেশি হয়, সে কারণে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বর্ষাকালে পানিবাহিত রোগের আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। তাই বাইরের খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা যায়, ততটাই ভালো। এবার থেকে ঘন ঘন রেস্তোরাঁ থেকে খাবার আনার সময় এই বিষয়টা খেয়াল রাখবেন। মাছ-মাংস না খেলে মন ভালো থাকে না? কিছু পুষ্টিবিদের মতে কিন্তু বর্ষাকালে মাছ, মাংস ও ডিম যতটা সম্ভব কম পরিমাণে খাওয়া যায়, ততই ভাল। বিশেষ করে মাছ, কারণ এটি মাছেদের প্রজননের সময়। সামুদ্রিক খাবার খাওয়ার অভ্যাস থাকলে বর্ষাকালে সেটিও এড়িয়ে চলুন। রান্না করার সময় খাবারে রসুন ও পেঁয়াজের পরিমাণ কমান।
বর্ষার সময় শাক এড়িয়ে চলার কথা বলা হয় সব সময়। কারণ বর্ষায় গাছের পাতায় পোকামাকড় বাড়ে, আর খুব ভালো ভাবে তা পরিষ্কার করা সম্ভবও হয় না। এর ফলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সহজেই শরীরে প্রবেশ করতে পারে। জীবাণুযুক্ত এ সব শাক-সবজি পাকস্থলীর জন্য বিপজ্জনক। এ কারণে ডায়েরিয়া ও খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়। বর্ষাকালে পালং শাক না খাওয়াই ভালো। তাতে পেটে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে পেটের হাল খারাপ করে দিতে পারে ফুলকপি। আয়ুর্বেদ বলছে, বাত ও পিত্ত দশার জন্য দায়ী ফুলকপি। এই বর্ষাকালে সবজিটি এড়িয়ে চলুন। বর্ষায় ক্যাপসিকাম না খাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এতে বাত ও পিত্ত দশার বাড়বাড়ন্ত হয়।
কোনো সময়ই কেটে রাখা ফল খাওয়া উচিত না। এই সময় তো নয়ই। বাতাসের সংস্পর্শে তার ওপর নোংরা ব্যাকটেরিয়া জন্মায়।
বর্ষার সময় কোল্ড ড্রিংক এড়িয়ে চলুন। কোল্ড ড্রিংক আমাদের শরীরে খনিজের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে উৎসেচকগুলো ঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। এতে মারাত্মক হজমের সমস্যা তৈরি হয়। পেটে ইনফেকশনও হতে পারে।
বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এলে একটু গরম পানি করে গোসল সেরে ফেলুন। সতেজ হওয়ার পাশাপাশি বৃষ্টির পানির ক্ষতিকারক ব্যাক্টিরিয়াও ধুয়ে ফেলা যাবে। নইলে এই বিপজ্জনক ব্যাক্টেরিয়া নষ্ট করে দেবে চুল। চুল পড়ার মতো সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।
বর্ষায় কোনো ধরনের ফল বা সবজির রস বাইরে খাওয়া যাবে না। যদি একান্তই খেতে হয়, তবে বাড়িতেই বানিয়ে নিতে হবে। বাইরে তৈরি বর্ষায় ফলের রস, কুলফি, ঘোল, আখের রস, দই জাতীয় খাবার নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
যে কোনো খাবার ভালো করে রান্না করে সিদ্ধ করে খাওয়া উচিত। কাঁচা খাবার বর্ষায় না খাওয়াই ভালো। বর্ষায় এ ধরনের খাবারে জন্ডিস, টাইফয়েডের আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
যা খেলে ভাল থাকবে শরীর
বর্ষায় অনেক সময়েই ইচ্ছে না থাকলেও ভিজতেই হয়। তাই খাবারের মেনুতে রাখুন প্রচুর ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, মৌসুমী ফল, বিশেষত আমলকী। ঠান্ডা লাগার প্রবণতা কমাতে এর বিকল্প নেই।
অনেকেরই প্রায় সারা বছর ঠান্ডা লাগার প্রবণতা থাকে। হাঁচি-কাশির তেমন প্রভাব থাকলে অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ, বাড়িতে তৈরি তুলসিপাতার রস-বাসক পাতার রস-আমলকী মেশানো পানীয়ের উপর আস্থা রাখুন। অ্যান্টিঅ্যালার্জির ওষুধ খেলে তা অবশ্যই পরামর্শ নিন নিজস্ব চিকিৎসকের।
ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু উপকারী। শ্বাসকষ্ট দূর করতে মধু দারুণ কাজ করে। আধা গ্রাম গুঁড়া করা গোলমরিচের সঙ্গে সমপরিমাণ মধু ও আদা মিশিয়ে দিনে তিনবার খেলে হাঁপানি রোগে উপকার পাওয়া যায়।
বর্ষার মৌসুমে শরীর সুস্থ রাখতে মৌসুমী সবজি ও ফল প্রচুর পরিমাণে খাওয়া জরুরি। আপেল, জাম, লিচু, ন্যাশপাতি এই সব মরসুমি ফল খান। এ ছাড়া অবশ্যই খাদ্যতালিকায় রাখুন ওল, মিষ্টি আলু, গাঁঠি কচু, করলা ইত্যাদি সব্জি।
শরীরকে সুস্থ রাখতে ও শরীর আর্দ্র রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। পানি শরীর থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান বের করে দিতে সাহায্য করে। তাই পর্যাপ্ত পানি পানের অভ্যাস থাকলে বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকা যায় বর্ষাকালে। সুস্থ থাকতে আদা, গোলমরিচ, মধু, পুদিনা, তুলসী চা ইত্যাদি খেতে পারেন। এইসব চায়ে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে।
ডাবের পানি পান করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। কারণ ডাবের পানিতে রিবোফ্লোবিন, নিয়াসিন, থায়ামিন ও পিরিডক্সিনের মতো উপকারী উপাদানে ভরপুর। ডাবের পানি প্রতিদিন পান করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে জীবাণুরা আক্রমণ করতে পারে না।
বর্ষায় নিয়মিত লেবু খেতে পারেন। কারণ লেবুতে ‘রুটিন’ নামের বিশেষ ফ্লাভোনয়েড পাওয়া যায়, যা শিরা ও রক্ত জালিকার প্রাচীর শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। এ ছাড়া লেবুর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন সি ও বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, যা সর্দিকাশির সমস্যা দূরসহ বিভিন্ন ক্যানসার নিরাময়ে সহায়তা করে। স্নায়ু ও মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, ফুসফুস পরিষ্কার রাখে এবং হাঁপানির সমস্যা দূর করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বর্ষায় খালি পেটে রসুন খাওয়া হলে এটি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে। খালি পেটে অথবা নাশতার পর ১ কোয়া রসুন খাতে পারেন। সামান্য তেলে অর্ধেক কোয়া রসুন ভেজে তা এক টেবিল চামচ মধুর সঙ্গে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে খেলে বুকে জমে থাকা কফ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। শরীর থেকে জ্বর ও ঠান্ডা দূর করতে প্রতিদিন ২-৩ কোয়া রসুন কাঁচা খেতে হবে।
বর্ষায় ঘন ঘন জ্বর নতুন কোনো ব্যাপার নয়। রোজ হালকা এক্সারসাইজ করুন। তাতে শরীর অনেকটাই ফিট থাকবে। রক্ত সঞ্চালন থেকে শুরু করে শরীরের যেকোনো ব্যাথা বা কষ্ট কমাতে যোগ ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। জিমে যেতে না পারলেও, হালকা এক্সারসাইজ করুন ঘরে বসে৷
(ঢাকাটাইমস/১ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন