সরকারি চাকরি: মেধায় নিয়োগ ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
মঙ্গলবার দুপুর কারফিউ শিথিল থাকার সময়ে এ প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রজ্ঞাপনে অনুযায়ী মেধাভিত্তিক ৯৩ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ ভাগ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ ভাগ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ ভাগ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্যপদসমূহ সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলতি মাসের শুরুর দিন থেকে রাজপথে নামেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। কোটা বাতিলে সরকারের প্রজ্ঞাপনের বিপরীতে হাইকোর্টের একটি রায়ের প্রেক্ষিতে আপিলের শুনানি সামনে রেখে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধে। এক পর্যায়ে গোটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাভাবিক চলাচল, রাজধানীর সঙ্গে আন্তঃজেলার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। বিঘ্নিত হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ছন্দপতন ঘটে নাগরিক জীবনে। আতঙ্ক আর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।
গত ৪ জুলাই চেম্বার আদালত কোটা বাতিলে হাইকোর্টের দেওয়া ৫ জুনের রায় বহাল রাখার আদেশ দেন। এরপরই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সারাদেশ অবরোধের ঘোষণা দিয়ে তারা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি দেন। এরপরই মূলত অকার্যকর হয়ে পড়ে সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম। এরপর ১০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়েও ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন। শুনানির জন্য ৭ আগস্ট নতুন দিনও ধার্য করেন। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আন্দোলন শুরুর তিন সপ্তাহ পর গত ২১ জুলাই হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেন।
কিন্তু এরই মধ্যে ঝরে পড়ে অসংখ্য প্রাণ। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজধানীর কাজলায় পুলিশের গুলিতে ঢাকা টাইমসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান মেহেদীসহ একাধিক সাংবাদিকও প্রাণ হারিয়েছেন।
১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রথম কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘ ২১ বছর তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত সংবিধানের মূলনীতির আলোকে এই সুযোগটা নিয়েছিল বিভিন্ন সময়ের সরকার। সংবিধান কোটা পদ্ধতিকে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয় হিসেবে যেকোনো সময় তা কমানো-বাড়ানো বা রাখা না রাখার এখতিয়ার সরকারকে দিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিসিএসসহ সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এরমধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। বাকি ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এবং এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ছিল। কোনো কোনো চাকরিতে প্রায় ৯০ শতাংশেরও বেশি ছিল কোটায় সংরক্ষিত।
২০১৮ সালের শুরুর দিকে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেসময় শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা ৫৬ শতাংশ না হয়ে ১০ শতাংশ করা হোক। তাদের দাবির মুখে ওই বছরই সরকারি চাকরিতে পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই সময় দুটি প্রজ্ঞাপনে ভিন্ন ভিন্ন আদেশ জারি করা হয়। বছরের শুরুর দিকে ৪ এপ্রিল ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদ) চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বাতিল করার ঘোষণা আসে। পরে ১০ অক্টোবর পৃথক প্রজ্ঞাপনে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদে চাকরির ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে কোটা রাখার আদেশ জারি করা হয়। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলে পরের বছর ৩০ জুন পূর্বের প্রজ্ঞাপনের অধিকতর ব্যাখ্যা দেয় সরকার। ওই প্রজ্ঞাপনে সরকার জানায়, চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, এতিম, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও আনসার-গ্রাম প্রতিরক্ষা কোটায় সম্ভাব্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে অপূর্ণ পদে জেলার প্রাপ্যতা অনুযায়ী মেধা তালিকার শীর্ষ থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো পদ সংরক্ষণ বা খালি রাখা যাবে না। এরও দুই বছর পর ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কয়েকজন শিক্ষার্থী সরকারের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। তারা মূলত সরকারের জারি করা প্রথম প্রজ্ঞাপনটি চ্যালেঞ্জ করেন। এ নিয়ে তখন হাইকোর্ট একটি রুল জারি করলেও তখন বিষয়টি আর বেশিদূর গড়ায়নি। কিন্তু গত জুনে বিষয়টি পুনরায় শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে। ৫ জুন হাইকোর্ট সরকারি ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ফলে পূর্বের কোটা পদ্ধতি পুনরায় বহাল হয়। রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে।
আপিল শুনানি শেষে গত ৪ জুলাই আপিল বিভাগ নট টুডে বলে আদেশ দেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়। ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। এ অবস্থায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী পৃথক আবেদন করেন। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ১০ জুলাই স্থিতাবস্থা জারির সঙ্গে শুনানির দিন ধার্য করেন। একইসঙ্গে লিভ টু আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে বলেন আদালত। এর প্রেক্ষিতে ১৬ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ এবং ১৮ জুলাই দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে আপিল আদালতে আবেদন করা হয়। চেম্বার আদালত এই আবেদনের জন্য নতুন দিন ধার্য করেন। এরপর ২১ জুলাই (রবিবার) দেশের সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে নির্বাহী আদেশে জারি করা সরকারি ছুটির মধ্যেই আদালত বসেন এবং চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।
সরকারি প্রজ্ঞাপন বাতিলের হাইকোর্টের রায় অসঙ্গতিপূর্ণ এবং এখতিয়াবহির্ভূত বলে উঠে আসে রায়ের পর্যবেক্ষণে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান, ‘আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় হাইকোর্টের রায় বাতিলের আবেদন করা হয়েছিল।’
শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নিজেও হাইকোর্টের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কোটার পক্ষের রিটকারী আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরীকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এরকম একটা নীতিনির্ধারণী বিষয়ে হাইকোর্ট রায় দিতে পারেন কি না’। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘২০১৮ সালে কোটা বাতিল হওয়ার পর এ নিয়ে কোনো কথা ছিল না। ২০২১ সালে রুল হওয়ার সময়ও এ নিয়ে কথা হয়নি। একটা রায় হাইকোর্ট দিয়েছেন। আজকে বিশেষ অবস্থায় আমরা কোর্টে বসেছি।’
আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, কোটা নির্ধারণ সরকারের নীতিনির্ধারণী তবু সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের এখতিয়ারবলে এবং সার্বিক ও যৌক্তিক বিবেচনায় সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮(৪), ২৯(১) ও ২৯(৩) অনুচ্ছেদে থাকা সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব লাভ নিশ্চিতের প্রতি লক্ষ্য রেখে কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরির ক্ষেত্রেও কোটার বিষয়টি রায়ে উঠে এসেছে। রায়ে বলা হয়, কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গে প্রতিনিধির জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো। তবে নির্ধারিত কোটার বিপরীতে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্যপদে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানিয়েছেন, সব ধরনের চাকরিতে আদালতের এই রায় কার্যকর হবে।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে আরও বলা হয়েছে, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজন সাপেক্ষে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
মঙ্গলবার জনপ্রশাসন, আইন, তথ্য ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আনিসুল হক জানান, এই রায়ে পূর্বের সমস্ত কিছু বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কোটা নির্ধারণের বিষয়টি সম্পূর্ণ সরকারের পলিসি মেটার। এটার এখতিয়ার সরকারের। আদালত অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে একটা রায় দিয়েছেন। সরকার চাইলে যেকোনো সময় এটা (কোটা) বাতিল করা, বাড়ানো বা কমানোর প্রয়োজন মনে করলে তা করতে পারবে’। এর ফলে সরকারের পূর্বের প্রজ্ঞাপনও বাতিল হয়ে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘একইসঙ্গে হাইকোর্টের রায় সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে।’
সোমবার আপিল আদালতের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, হাইকোর্টে রিটের পক্ষের আইনজীবি মনসুরুল হক চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম, তানিয়া আমীর, তানজিব উল আলম, এ এফ হাসান আরিফ, সারা হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ইউনুছ আলী আকন্দ এবং ঢাবির দুই শিক্ষার্থীর আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।
বিচারপতিদের আসন গ্রহণের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম ও তানিয়া রব কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তারা আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে পারেনি।’ তখন আদালত বলেন, ‘বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পাবেন।’ এ ছাড়া তানজিব উল আলম জ্যৈষ্ঠ আইনজীবীদের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করলে আদালত বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের কয়েকজনের বক্তব্য শুনব’।
ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত শুনানি চলে। পরে সোয়া ১টার দিকে আদালতে আসবেন জানিয়ে এজলাস ত্যাগ করেন বিচাপতিরা। এরপর দুপুর দেড়টায় রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আদালতের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আব জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি কাশেফা হোসেন।
(ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/এসআইএস/এফএ)

মন্তব্য করুন