সাংবাদিক হাসান মেহেদীর শেষ কণ্ঠ

মোরশেদুল জাহের
| আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১৭:০২ | প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১৬:০২
কোটা সংস্কার আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্বপালনের সময় বৃহস্পতিবার গুলিতে নিহত হাসান মেহেদী আগের দিন ‘শান্তি নাকি নতুন পরিস্থিতির অপেক্ষা’ টাইটেলের ভিডিওতে সর্বশেষ কণ্ঠ দেন।

সেদিন বুধবার। সকাল থেকে দুদক বিটে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দুপুরের পর নীলক্ষেত এলাকায় ছুটে যান। সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা এবং হল ছাড়তে নির্দেশ ছাত্রছাত্রীদের। কেউ ছাড়ছেন, কেউ ছাড়তে নারাজ। একই সঙ্গে চলছে বিক্ষোভ। সব দিকেই খোঁজ রাখছেন সিনিয়র রিপোর্টার মেহেদী হাসান। ঘটনার তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ নিতে ছুটছেন এখান থেকে ওখানে।

বিকালে ফিরলেন অফিসে। নিজের ডেস্কে বসে লিখছেন সংবাদ। ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা নিয়ে একটি ভিডিও স্টোরি বানানোর প্রস্তুতি চলছে। তার জন্য দরকার তরুণ ভারী কণ্ঠ (ভয়েস)। মেহেদীকে বলতেই উঠে এলেন তিনি। বললেন, স্ক্রিপ্ট দিন।পড়ে বললেন, আর একটু ছোট করলে ভালো হয়। তার পরামর্শে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয় স্ক্রিপ্ট।

ক্রমশ দেশজুড়ে ব্যাপ্তি লাভ এবং তাতে নানা পক্ষের হামলায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় বিস্ফোরণোন্মুখ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি-বেসরকারি কলেজ। কিন্তু তার যে বিপুল প্রতিক্রিয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে, এতে শান্তি ফিরবে নাকি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেই প্রশ্ন উঠে এসেছে স্ক্রিপ্টে। টাইটেল- শান্তি নাকি নতুন পরিস্থিতির অপেক্ষা

কে জানত, অমোঘ নতুন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াবে বাংলাদেশ, তার বলি হবে তরুণ সাংবাদিক মেহেদী হাসান, অনিশ্চিত ভবিতব্যে সমর্পিত হবে তার স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনরা। আর প্রিয় সহকর্মী হারানোর বেদনায় নীল হবে ঢাকা টাইমস।

বৃহস্পতিবার যাত্রাবাড়ীতে সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত সাংবাদ হাসান মেহেদী।

বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে হাসান মেহেদী শেষ কণ্ঠ দেন ঢাকাটাইমস ডিজিটালের ভিডিও কনটেন্টের জন্য। একে একে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তবু উত্তাপ কমছে না, বিক্ষোভ চলছে ভিডিওর থামনেলে শান্তি নাকি নতুন পরিস্থিতির অপেক্ষা টাইটেলের স্ক্রিপ্টটি ছিল এমন-

কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে হল ছাড়তে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর বুধবার সিন্ডিকেট সভা বসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। দুপুরের পর একে একে আসতে থাকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ধের খবর। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, জগন্নাথ, বুয়েট, ডুয়েট- সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট প্রায় একই সময়ে তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা প্রচার করে।

আজ ও কাল দুপুরের মধ্যে হল ছাড়তে হবে শিক্ষার্থীদের। ইতিমধ্যে কোথাও কোথাও হল ছাড়তে শুরু করেছেন তারা। কোথাও বা ক্যাম্পাসে অবস্থান করার ঘোষণা দিচ্ছেন। ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ।

প্রশাসন বলছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে বন্ধ করা হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে তাদের আন্দোলন থামানো যাবে না, বলছেন শিক্ষার্থীরা। দাবি পূরণের মধ্য দিয়ে তারা সহপাঠীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে চান।

এদিকে মঙ্গলবারের সংঘাতে নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। তাতে কোথাও কোথাও বাধা দিয়েছে পুলিশ। দেশের বেশ কয়েক জায়গায় বিক্ষোভ ও অবরোধের সংবাদও পাওয়া গেছে।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হবে, নাকি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

পরদিন বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আন্দোলন পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বহু হতাহতের খবর আসছে। সাংবাদিক মেহেদী হাসান ছুটে গেলেন মাঠের খবর সংগ্রহ করতে। যাত্রাবাড়ীর কাজলায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের গোড়ায় পুলিশের খুব কাছে থেকে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। অন্য সাংবাদিকদের ভিডিওতে এমনই দেখা গেছে তাকে।

প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের কাছ থেকে আমরা হাসান মেহেদীর গুলিবিদ্ধ হওয়া নিয়ে অনেক তথ্য পাচ্ছি। এখানে তার উল্লেখ করছি না। কেবল একজন সাংবাদিকের ভাষ্য বলি- সারা দিন অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে থেকে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েই সংবাদ সংগ্রহ করেন হাসান মেহেদী। বিকালে পুলিশের একটি এপিসি থেকে বিভিন্ন দিকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে টিয়ার শেল ও গুলি ছোড়া হচ্ছিল। এ সময় হাসান মেহেদী গুলিবিদ্ধ হন।

পুলিশের সঙ্গে থেকে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছেন সাংবাদিক হাসান মেহেদী (বাঁয়ে খয়েরি পোলো-শার্ট পরিহিত)

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার ওপরের অংশে গুলিবিদ্ধ হন মেহেদী। প্রায় ১০ মিনিট সেখানে পড়ে ছিলেন তিনি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, তাকে উদ্ধার করতে যেতে পারেনি কেউ। পরে দায়িত্বরত কয়েকজন সাংবাদিক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদীর বুকে-গলায়, মুখে-কপালে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন। এমনকি তার পিঠেও অসংখ্য হতচিহ্ন। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট বলছে- গান শুট ইনজুরড।

গত শুক্রবার সকালে ময়নাতদন্ত শেষে হাসান মেহেদীর মরদেহ আনা হয় রাজধানীর রমনার ইস্কাটন গার্ডেনের ঢাকা টাইমস অফিস প্রাঙ্গণে। এ সময় সহকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক শোকাবহ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় তার জানাজা।

দুই শিশুকন্যার বাবা হাসান মেহেদী। তার আদরের কন্যারা জানে না, আর কোনোদিন বাবার স্নেহছোঁয়া পাবে না তারা। কিন্তু তারা বাবার অপেক্ষার প্রহর গুনছে, মায়ের কাছে নিশ্চয়ই জানতে চাইছে তাদের বাবা কখন আসবে। মেহেদীর স্ত্রী কী জবাব দিচ্ছেন তাদের?

তরুণ সাংবাদিক হাসান মেহেদীর এমন অপঘাতে মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুন হন, কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকে বছরের পর বছর, এমনকি যুগ যুগ ধরে। সাংবাদিক হাসান মেহেদী হত্যার দ্রুত বিচার দাবি সাংবাদিক সমাজের।

(ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

গণমাধ্যম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

গণমাধ্যম এর সর্বশেষ

৫২ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে হয়রানি বন্ধে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়ে ভারতের চার সাংবাদিক সংগঠনের চিঠি

ইউএনবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আমানউল্লাহ খান মারা গেছেন

এক দশক পর দেশে ফিরে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল

‘হাসিনা সরকারের পতনে একটু হলেও অবদান রেখেছি, মামলা থেকে মুক্তি কেন নয়?’

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী এক দশক পর দেশে ফিরছেন

হ্যাকারদের কবলে প্রথম আলো অনলাইন 

গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী সব কালাকানুন বাতিল দাবি

গণমাধ্যমকে ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করার দাবি

কালের কণ্ঠের সম্পাদক হলেন কবি হাসান হাফিজ

নিউজ টোয়েন্টি ফোরের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলেন কাদের গনি চৌধুরী

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :