একজন সাংবাদিকের মৃত্যু হলে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও মৃত্যু ঘটে

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনে পৃথিবীর প্রতিটা খবরও এখন আমরা পাচ্ছি মুহূর্তেই। রাষ্ট্র-অঞ্চলে বিভক্ত পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটিও একটি রাষ্ট্র হিসেবে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে আছে। এখানেও প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যায়। জন্মালে মৃত্যু আসবেই। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। কিছু মৃত্যুতে তুলকালাম কাণ্ডও ঘটে যায়। একটি মৃত্যুর ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরও অনেক মৃত্যুও ঘটে যেতে পারে। মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, সভা, সমাবেশ হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পৃথিবীতে আইনের মাধ্যমে কারো কারো শাস্তিও নিশ্চিত হয়। দোষীদের যে শাস্তিটা হয়- সেটা হলো সারাজীবন কিংবা জীবনের বড়ো একটা অংশ একাকী অন্ধকার কারাগারে কাটানো কিংবা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। বলা বাহুল্য এসব হয়- যে মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতির নিয়মে না হয়ে অন্য কারো প্ররোচনায় কিংবা সরাসরি আক্রমণে ঘটে থাকে। অর্থাৎ যে মৃত্যুর জন্য অন্য কারো দায় থাকে, মৃত্যু ঘটানোর জন্য যখন কেউ না কেউ অভিযুক্ত হয় সেসব মৃত্যুকেই অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে। বিভিন্ন দুর্ঘটনা-দুর্যোগেও অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে থাকে। সেসবের জন্য সরাসরি কেউ অভিযুক্ত না হলেও ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপনার দায়-দায়িত্ব নিশ্চয়ই থাকে। তবে যেসব মৃত্যুতে সরাসরি কারো দায় থাকে সেসব অস্বাভাবিক মৃত্যুরই পোশাকি নাম ‘খুন’।
স্বাভাবিক বা দুর্যোগ-দুর্ঘটনা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিনই কেউ না কেউ খুনের শিকার হন। এসব ঘটনায় পরবর্তীতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়ে অনেক নতুন ও বড়ো সংকটের কিছুর জন্ম দেয়। সব খুনেরই যে রাষ্ট্রে ও সমাজে আইনি বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তা নয়। আর হয় না বলেই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এই ক্ষোভ থেকে জন্ম হয় নতুন নতুন ইতিহাস। হতে পারে সেটা রক্ত নদীর ওপর দিয়ে ভেসে আসা কোনো সুখ কিংবা দুঃখের বাহন হয়ে। ১৯৭১ সালে এরকম শত সহস্র রক্তনদী পেরিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কিন্তু সেই একাত্তরেই রক্তের ইতিহাস থেমে যায়নি। ঘুরে ফিরে বারবার রক্তগঙ্গা এসেছে নদী বিধৌত এই বাংলায়। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই এমন এক মৃত্যু এসেছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন একটি ‘রক্তাক্ত ইতিহাস’ যুক্ত করেছে।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ সেদিন বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন ইতিহাসে সেটা উজ্জ্বল তারকা হয়ে জ্বল জ্বল করবে যুগ যুগ ধরে নিঃসন্দেহে। তার মৃত্যুর পর বিদেশি এক সাংবাদিক লিখেছেন, ত্রিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে বহু চড়াই-উতরাই দেখেছেন কিন্তু এমন মৃত্যু তিনি দেখেননি। বহু মানুষকে, নেতাকে, বক্তাকে মৃত্যুর সামনে দাঁড়ানোর কথা বলতে শুনেছেন; কিন্তু এভাবে কাউকে দাঁড়াতে দেখেননি।
বাস্তবেও এমন ঘটনা ক্ষণে ক্ষণে হয় না। এমন মানুষও ক্ষণে ক্ষণে জন্মায় না। এমনই এক একজন মানুষ ছিলেন ট্যাংক মানুষ। তিয়েনানমেন স্কোয়্যারে ১৯৮৯ সালে যিনি চাইনিজ সামরিক বাহিনীর ট্যাংকের সামনে একাই দাঁড়িয়েছিলেন হাজারো মানুষের মৃত্যুর প্রতিবাদে। আবু সাঈদও ছিলেন তেমনই একজন। এরা প্রতিদিন জন্মায় না, ইতিহাস বদলাতেই এরা যুগে যুগে জন্মায়। এক আবু সাঈদের মৃত্যুর পর গোটা বাংলাদেশ জেগে ওঠে কোটা-সংস্কারের প্রতিবাদে। এরপর টানা কয়েকদিন ধরে দুর্বৃত্তদের দ্বারা নানা নৈরাজ্যের মধ্যে চলা নৃশংসতা, বর্বরতা, নির্মমতা, পৈশাচিকতায় এমন এক রক্তনদীর সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে- যা স্বাধীনতার পর আর কখনোই ঘটতে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পর কোনো একক ঘটনায় একসঙ্গে এত মানুষ কখনো খুনও হননি। এক আবু সাঈদের লাশের ওপর দিয়ে রক্তনদী বয়ে গেছে কয়েকদিন। শিক্ষার্থী, সাধারণ পথচারী, কুলি, দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকেরও মৃত্যু ঘটেছে কয়েকদিন ধরে চলা স্মরণকালের এই ভয়াবহ সহিংসতায়।
পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটুক, ভালো কিংবা মন্দ; তার সবটাই উঠে আসে সাংবাদিকের কলমে, ক্যামেরায়। মূলত এজন্যই সাংবাদিক বা সাংবাদিকতাকে বলা হয় সমাজের আয়না। আয়না যখন কর্দমাক্ত হয় গোটা চেহারাটাই তখন কর্দমাক্ত দেখায়। সমাজের ইতিবাচক দিকগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তি ও সমাজের অন্যায়, অনাচার ও ত্রুটিগুলো আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন সাংবাদিক। তারপর রাষ্ট্র সেগুলো পরিশুদ্ধ করে। রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে, পরিশুদ্ধতার লক্ষ্যে।
সাংবাদিকের মৃত্যুতে সমাজ ও রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটে কথার তাৎপর্য বুঝতে হলে আগে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বা রাষ্ট্র জন্মের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্যটা জানতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র জন্মের আগেও পৃথিবীতে ভিন্ন নামে-উপনামে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল। তারও আগে থেকেই মানুষ বাঁচার জন্য, ভালো থাকার জন্য, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনের জন্য দলবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করেছে। এই দলবদ্ধতাই ধীরে ধীরে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। প্রেক্ষাপট হিসেবে বিবেচনা করলে দেখা যায়- রাষ্ট্র ব্যবস্থা জন্মের আগে মানুষে-মানুষে, গোত্রে-গোত্রে, সমাজে-সমাজে, অঞ্চলে-অঞ্চলে হানাহানি কখনোই বন্ধ হয়নি। শৃঙ্খলাপূর্ণ মানবজীবনও কখনো পূর্ণমাত্রায় স্বস্তিতে থাকতে পারেনি। আধিপত্য বিস্তারের নেশা মানুষের ছোটো ছোটো দলকে, সমাজকে কুরে কুরে খেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটই পরবর্তীতে বৃহৎ দল ও অঞ্চল নিয়ে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। এর একটাই উদ্দেশ্য- মানুষের ভালো থাকা, নিরাপদে বেঁচে থাকা। যেখানে মানুষের বেঁচে থাকা যতটা নিরাপদ সেখানে রাষ্ট্রও ঠিক ততটাই সফল।
একজন মৃত মানুষের সামনে যা কিছুই ঘটুক, সে কিছুই বলতে পারে না বা কিছুই করতে পারে না। কারণ সে মৃত। সে দেখেও দেখে না, চোখের সামনে ঘটলেও কিছু শোনে না। ঠিক তদ্রুপ রাষ্ট্র যখন নির্লিপ্ত হয়ে যায়, মানুষের মৃত্যুতে ব্যথিত না হয়, মানুষের প্রাণ রক্ষায় যথাযথভাবে এগিয়ে না আসে- সমাজের আয়না সাংবাদিকের প্রাণহানি হলেও রাষ্ট্র থাকে অনেকটাই নিশ্চুপ- তখন সে রাষ্ট্রকে অনেকটা মৃতই বলাই যায়।
গত ১৮ই জুলাই পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে রাজধানীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদী। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে কোটা-সংস্কার আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। হাসান মেহেদীর মতো একজন সৎ, মেধাবী, আত্মপ্রত্যয়ী ও কাজের প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল সংবাদকর্মীকে হারিয়ে দৈনিক ঢাকা টাইমস পরিবার যারপরনাই শোকাহত, স্তব্ধ ও বাক্রুদ্ধ। কোটা-সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘাত-সংঘর্ষের ভিতর থেকে সংবাদ সংগ্রহ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও নির্ভীক সংবাদকর্মী হাসান মেহেদী সেখান থেকে তাৎক্ষণিক ঘটমান বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। কিন্তু অকুতভয় সেই সংবাদকর্মীও গুলিবিদ্ধ হয়ে নির্মমভাবে নিহত হলেন- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শুধু কোটা-সংস্কার আন্দোলন নয়, যেকোনো ধরনের আন্দোলনেই একজন সংবাদকর্মী কখনো কারো প্রতিপক্ষ থাকে না- না আন্দোলনকারীদের, না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একজন সংবাদকর্মী চলমান ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করতেই কেবল ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকেন। তাকে কেন গুলিবিদ্ধ হয়ে কারো অবিবেচনাপ্রসূত বিকারের বলি হতে হবে! অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো- হাসান মেহেদীর মতো মেধাবী ও কর্মিষ্ঠ একজন সাংবাদিককে গুলিবিদ্ধ হয়েই অকাতরে প্রাণ দিতে হলো। হাসান মেহেদীর তিন বছর ও সাত মাসের দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। সদ্য বিধবা তার স্ত্রী এবং এতিম দুই সন্তানের এখন কী হবে? কে নেবে এদের দায়ভার?
যে সাংবাদিক সমাজের ত্রুটি, বিচ্যুতি, মানুষের অধিকারের কথাগুলো রাষ্ট্রের কানে পৌঁছে দেবে; সেই সাংবাদিক যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হন তখন সকলের বাক্রুদ্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। মনে রাখতে হবে- সাংবাদিকরা যেহেতু দেশের আপামর মানুষের হয়ে কথা বলেন, সেই সাংবাদিকের যখন মৃত্যু হয় তখন গোটা মানুষ্য সমাজেরও এক রকমের মৃত্যু ঘটে। তখন রাষ্ট্রের প্রতিও মানুষের কিছুটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়। মানুষ ছাড়া রাষ্ট্র তো অর্থহীন।
উল্লেখ্য, দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা-সংস্কার আন্দোলন চলেছে। প্রথম অবস্থায় আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই পালন হচ্ছিল। কিন্তু গত ১৫ই জুলাই সোমবার থেকে পুলিশ ও ছাত্রলীগের আক্রমণে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা করা হয়। পুলিশ ও ছাত্রলীগ রাজধানীকেন্দ্রিক আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে হামলে পড়ে। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সারা দেশে সর্বাত্মক শাটডাউন ঘোষণা করে। এরপরই কোটা-সংস্কার আন্দোলনটি সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন সংঘাত-সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় প্রায় দুইশতাধিক মানুষ। প্রথমে বিজিবি, পরে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামায় সরকার। দেশ আস্তে-আস্তে এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে ক্রমাগত। এক সময় হয়তো সবকিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলবে; কিন্তু হাসান মেহেদীরা আর কখনো ফিরে আসবে না। অস্বীকার করা যাবে না যে- সাংবাদিক হাসান মেহেদীদের মতো মেধাবী তরুণদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য নেতিবাচক বার্তাই দিয়ে যায়। আমরা হাসান মেহেদীসহ পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সকল সাংবাদিক হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।শাহনূর শাহীন: সিনিয়র সহসম্পাদক, ঢাকা টাইমস

মন্তব্য করুন