অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি, গবেষণা
অ্যান্টিবায়োটিক গ্রিক শব্দ ‘অ্যান্টি’ ও ‘বায়োস’ থেকে এসেছে। অ্যান্টি অর্থ বিপরীত ও বায়োস অর্থ জীবন। অর্থাৎ এটি জীবিত মাইক্রোঅর্গানিজমের বিরুদ্ধে কাজ করে। যেসব রোগ সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয়, তা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এজন্য ভাইরাসজনিত রোগের বিপরীতে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকরী ।
অ্যান্টিবায়োটিক, জীবনদায়ী ওষুধ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। অ্যান্টিবায়োটিক এক ধরনের অণুজীবনাশী পদার্থ; যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা বর্তমান বিশ্বে একটি ভয়ংকর স্বাস্থ্য সমস্যা। ব্যাকটেরিয়া তথা অণুজীবের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা যত কমে যাবে তত বেশি এসব জীবাণুর সংক্রমণ বেড়ে যাবে। পাশাপাশি চিকিৎসার উপায় বা প্রতিষেধক কমে যাবে ও সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ নিরাপদ মনে করে যথেচ্ছ খেয়ে ফেলার অভ্যাসই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। যে অ্যান্টিবায়োটিকের রোগ সারানোর কথা ছিল, তা-ই ক্রমশ প্রতিরোধী করে তুলছে শরীরকে। আর এর দৌলতেই এক শ্রেণির জীবাণু ক্রমশই অপরাজেয় হয়ে উঠছে। অ্যান্টিবায়োটিক আর তাদের বধ করতে পারছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স’।
সম্প্রতি ‘দ্য ল্যানসেট’-এর গবেষণাতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের কথা উঠে এসেছে। গবেষকেরা বিশ্বের ২০৪টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দাবি করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের কারণেই প্রায় ৩ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। শিশু ও বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি।
দু’দিনের জ্বর সারাতে ওষুধের দোকান থেকে চেনা অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে ফেলেন অনেকেই। পেটের অসুখ হলেই যথেচ্ছ ব্যবহার হয় জনপ্রিয় মেট্রোনিডাজোল গোত্রের ওষুধ। এ ভাবেই সাধারণ অসুখবিসুখের সঙ্গে লড়তে কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। শুধু নিজেই খাচ্ছেন না, বাড়ির শিশু ও বয়স্কদের চিকিৎসাও অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজে সেরে ফেলছেন নিজেই।
মেডিসিনের চিকিৎসকের মতে, প্রতি বছর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে মৃত্যু হয় অনেক শিশুর। সচেতন না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এমন সময় আসবে, যখন বেশ কিছু চেনা অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না শরীরে। অসুখ প্রতিরোধী অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যক্ষমতা হারাবে। শক্তিশালী হয়ে উঠবে জীবাণুরা।
চিকিৎসকরা বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ শরীরে যাওয়ার পর তার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা লাভ করে বেশ কিছু ব্যাক্টেরিয়া, পরজীবী। ফলে নির্দিষ্ট অসুখ প্রতিরোধে যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, একটা সময়ের পর তা আর কাজ করে না। এর বিকল্পও তেমন কিছু না থাকায়, ধীরে ধীরে মৃত্যু ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
সবচেয়ে বিপজ্জনক যা ঘটছে তা হল এই যে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী কিছু জীবাণুর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে, যাদের বলা হয় ‘সুপারবাগ’। আগামী দিনে বিশ্ব জুড়ে নতুন মহামারির কারণ হতে পারে এই সব সুপারবাগ। এদের ঘায়েল করার কৌশল তেমনভাবে জানা নেই। তবে গবেষণা চলছে। এই সুপারবাগেরা এমন ধরনের জীবাণু, যারা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে সহজেই।
প্রতিদিন জ্বর, সর্দি, কাশি, শরীর ব্যথা, আমাশয় আক্রান্ত কয়েক লাখ মানুষ ওষুধের দোকানদার, অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির পরামর্শে অথবা নিজের ইচ্ছায় অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করেন। বেশির ভাগই ব্যবহারে কোনো নীতিমালা মানেন না। এভাবে অনিরাপদ ব্যবহার অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে তুলছে। এতে করে ভবিষ্যতে কেউই নিরাপদ থাকবে না।
অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না। এটি কেবল ব্যাকটেরিয়াকে নাশ করতে পারে। আমরা প্রতিদিন নানা ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছি; যেমন: ফ্লু, ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি, টনসিল বা গলনালির প্রদাহ, ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি। এসব রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই।
সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ও ভুল ব্যবহারের ফলে মানবদেহে ভয়ংকরভাবে রেজিস্ট্যান্ট বা ওষুধ অকার্যকর করার অনুজীবের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে অসংখ্য সংক্রমণ ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের দিকে ঝোঁকেন। এর মধ্যে অন্তত ২১টি সংক্রমণ রোগের নাম পাওয়া গেছে। যেগুলোতে মানুষ হরহামেশা আক্রান্ত হন। এরমধ্যে রয়েছে-টাইফয়েড, পোলিও, মায়েলাইসিস, হেপাটাইটিস (এ.ডি), কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয় ও বিভিন্ন কৃমি। এগুলো খাদ্য ও পানীয় জাতীয় সংক্রমণ। অপরদিকে, বায়ুবাহিত সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হুপিং কাশি, মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, ব্রংকিওলাইটিস, মাম্পস, রুবেলা, বসন্ত, হাম ও করোনা। এই ২১টি সংক্রমণ রোগ ছাড়াও অদেখা আরও বহু রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ অর্থ খরচ করে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে থাকে। কিন্তু কাজ না হওয়ায় চিকিৎসকের কাছে ফের যান। তাকে নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এভাবে রোগীও একটা চেইন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েন।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার অভ্যাস থাকলে জেনে নিন, কখন কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাবেন-
অ্যান্টিবায়োটিক চললে প্রথমেই যে খাবারটি বর্জন করবেন, তা হল টক জাতীয় খাবার। চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে সব খাবারে অ্যাসিডের মাত্রা বেশি, সেই সব খাবার একেবারেই খাওয়া যাবে না। যেমন, চকোলেট, টক জাতীয় ফল বা সবজি (লেবু, টমেটো) ইত্যাদি। কারণ অ্যাসিডযুক্ত খাবার খেলে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। অনেক সময় বিপজ্জনকও হয়ে দাঁড়ায়।
অ্যান্টিবায়োটিক চললে সমস্ত দুগ্ধজাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, দুধ, চিজ ও পনিরে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে। ক্যালসিয়াম অ্যান্টিবায়োটিককে শরীরে গ্রহণ করতে বাধা দেয়। তবে লস্সি খাওয়া যেতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক চলাকালীন অ্যালকোহল শরীরের পক্ষে মারাত্মক। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সঙ্গে যদি কোনও ব্যক্তি মদ চালিয়ে যান, তার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই। কারণ অ্যালকোহল অ্যান্টিবায়োটিককে কাজ করতে তো দেয়-ই না, উপরন্তু বিপজ্জনক হয়ে যায়।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের সময় রোগীদের নির্দিষ্ট কিছু সবজি সালাদ এড়িয়ে চলা উচিত। ডাক্তারদেরও উচিত রোগীদের সালাদ এবং কাঁচা শাকসবজি এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া। কারণ এই সবজি সালাদ রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগ তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। তারা বলছেন, কাঁচা ফল ও সবজিতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিনযুক্ত ব্যাকটেরিয়া লুকিয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে সুপার মার্কেটের প্রস্তুতকৃত মুলা ও গাজরের সালাদে এই ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিকের বিশেষ কিছু উপাদান ক্যালশিয়ামের সাথে মিশে দানা বা জট হয়ে যায়৷ ফলে তা পেটের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করতে পারে না৷ তাই অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে দুধ খাওয়া উচিত নয়৷ তবে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার দুই ঘণ্টা আগে বা পরে দুধ পানে বাধা নেই৷
ওষুধকে পুরোপুরি কাজে লাগতে গ্রেপফ্রুট বা স্বাদে টক, বড় কমলাজাতীয় ফলের ভেষজ উপাদান অন্ত্র বা পেটের এনজাইমকে দমন করে বা বাধা দেয়৷ তাই ওষুধের সাথে গ্রেপফ্রুট না খাওয়াই স্রেয়৷ অর্থাৎ চিকিৎসা চলাকালীন গ্রেপফ্রুটকে একেবারে দূরে রাখুন৷
আয়রন ট্যাবলেটের কাজ হচ্ছে অন্ত্রের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করা৷ কিন্তু এই ট্যাবলেটের সঙ্গে যদি চা বা কফি পান করা হয়, তাহলে তা মুত্রের মাধ্যমে তাড়াতাড়ি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়৷ ফলে আয়রন ট্যাবলেটের উপকারিতাও কমে যায়৷ তাই রক্তস্বল্পতার কারণে যারা আয়রন ট্যাবলেট খান, তারা অবশ্যই ট্যাবলেট সেবনের দু’ঘণ্টা আগে অথবা পরে চা বা কফি পান করবেন৷
তৈরি মাংসের খাবারে থাকে প্রচুর পরিমাণে টিরামিন৷ তাই যারা বিষণ্ণতায় ভোগেন তাদের চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে এ সব খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো৷ কারণ তা সুস্থ হওয়া দীর্ঘায়িত করে এবং এতে উচ্চরক্তচাপও হতে পারে৷
ব্রকোলির মতো সবুজ সবজি বা সালাদে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘কে’, যা রক্ত জমাট না বাঁধতে সাহায্য করে৷ তবে যারা রক্তের ঘনত্ব কমাতে, বিশেষ করে পা ফুলে যাওয়ার জন্য ওষুধ খান, তাদের বলছি, সেসব ওষুধের সাথে সবুজ সবজি খেলে ওষুধের উপকারিতা কমে যায়৷
যারা অ্যাজমা বা হাঁপানির ওষুধ সেবন করেন, তাদের গোলমরিচ না খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ৷ কারণ গবেষণায় বলছে, গোলমরিচের ঝাঁঝ অ্যাজমার ওষুধের কর্মক্ষমতা কমিয়ে তার গতিও ধীর করে দেয়৷ তাই যাদের হাঁপানি আছে, তারা গোলমরিচ এড়িয়ে চলুন৷
কর্টিসোন হলো এক ধরণের অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিনিঃসৃত হরমোন৷ যখন কেউ কর্টিসোন সেবন করবেন, তখন কোনোভাবেই তার সঙ্গে চিপস খাবেন না, বিশেষ করে কর্টিসোন ওষুধটি যদি ত্বকের সমস্যার জন্য হয়ে থাকে৷ কারণ কর্টিসোনে থাকা ন্যাট্রিউম পেট ব্যথা ও গলা ব্যথার কারণ হতে পারে৷
সেরিয়াল বা বিভিন্ন দানায় থাকা আঁশ ব্যথার ওষুধকে ভালোভাবে কাজ করতে তো দেয়ই না, বরং বাঁধার সৃষ্টি করে৷ অর্থাৎ পেট বা অন্ত্রকে দমন করে থাকে সেরিয়াল৷ তাই শষ্যদানা, আঁশ জাতীয় খাবার কোনো ব্যথার ওষুধের সাথে খাবেন না।
অ্যান্টিবায়োটিক চললে খাওয়া উচিত নয় ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারও। গম, যব, ভুট্টা, নানা ফাইবার সমৃদ্ধ শাক-সবজি থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অ্যান্টিবায়োটিককে কাজ করতে দেয় না ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার।
কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কফি থেকে দশ হাত দূরে থাকুন। কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে ক্যাফিন মিশলে শরীরে বিষক্রিয়া হয়ে যায়।
প্রচুর পরিমাণে আয়রন যুক্ত খাবারও অ্যান্টিবায়োটিকের যম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আয়রন ও ক্যালসিয়াম অ্যান্টিবায়োটিককে কাজ করতে দেয় না।
অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা বা রেজিসট্যান্স যে হারে বাড়ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে সুপার বাগ বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ভয়ানক প্রাণসংহারী জীবাণুর কাছে মানুষের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ও ভুল ব্যবহার, অতিব্যবহার আবার কখনো কম মাত্রায় ব্যবহার এই রেজিসট্যান্সের জন্য দায়ী। এ জন্য সতর্ক হতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/১৮ সেপ্টেম্বর/আরজেড)