নতুন প্রেসিডেন্ট বাছাই করে নিতে প্রস্তুত মার্কিনিরা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আজ। আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিসহ বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণে কে প্রভাব বিস্তার করবেন— ডোনাল্ড ট্রাম্প না কমালা হ্যারিস, সেদিকেই তাকিয়ে বিশ্ব। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে নানা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কেউ বলছেন ট্রাম্প, কেউ এগিয়ে রাখছে কমালাকে।
মঙ্গলবার এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের আগে শেষ মুহূর্তে 'সুইং স্টেট' বা দোদুল্যমান রাজ্যগুলো চষে বেড়াচ্ছেন দুই প্রার্থীই।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এক সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় কমালা হ্যারিস বলেছেন, গাজা যুদ্ধ অবসানে তিনি তার ক্ষমতা অনুযায়ী সবকিছুই করবেন। আর মিশিগানেই রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আরব আমেরিকান জনগোষ্ঠীর বাস।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ সময়ে আরব-সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর ডিয়ারবর্ন-এ সমাবেশ করেছেন। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ও ইসরায়েলকে আর্থিক সুবিধা দেয়া নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে থাকা ক্ষোভকে পুঁজি করে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
আরও কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ট্রাম্প ও হ্যারিস
নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে বিভিন্ন ইস্যুতে দুই প্রার্থীর যে অবস্থান তা নীচে তুলে ধরা হলো—
মূল্যস্ফীতি: কমালা হ্যারিস বলেছেন প্রথম দিন থেকেই তার অগ্রাধিকার হবে জীবন যাত্রার ব্যয় কমানো। গ্রোসারি বা দোকানে মূল্য বৃদ্ধি ঠেকানো, ক্রেতাদের সহায়তা এবং ন্যুনতম বেতন বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ নিবেন তিনি। আরও অনেক পশ্চিমা দেশের মতো মূল্যস্ফীতি বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রেও বেড়েছে।
অন্যদিকে ট্রাম্প ‘মূল্যস্ফীতির অবসান ঘটিয়ে আমেরিকাকে আবারো সাশ্রয়ী’ করার অঙ্গীকার করছেন। জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনতে তিনি আরও তেল উৎপাদনের কথা বলছেন। সুদের হার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে পারলে আবাসনের চাপ কমবে বলেও আশাবাদী ট্রাম্প।
আইন শৃঙ্খলা: কমালা হ্যারিস প্রসিকিউটর হিসেবে তার অভিজ্ঞতার সাথে ট্রাম্পের অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প মাদক কার্টেল ও দলগত সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি বলছেন, ডেমোক্র্যাটরা যেসব শহর পরিচালনা করছে সেগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ভরে গেছে। একই সঙ্গে তিনি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করলে তিনি ‘উগ্র বাম ও শত্রুদের’ বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী বা ন্যাশনাল গার্ড ব্যবহারের কথা বলেছেন।
গর্ভপাত: কমালা হ্যারিস গর্ভপাতের অধিকারকে তার প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছেন এবং তিনি দেশজুড়ে প্রজনন অধিকার বিষয়ে আইনের পক্ষে তার অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য গর্ভপাতের বিষয়ে তার অবস্থান এক জায়গায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কে জয়ী তা নির্ধারিত হবে কীভাবে?
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। একজন প্রার্থী তুলনামূলক কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। এর মূলে আছে দেশটির নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ নামের ২০০ বছর পুরনো একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই ইলেকটোরাল কলেজে যিনি ভালো ফল করেন তার হাতেই যায় হোয়াইট হাউসের চাবি। এ নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটারদের সরাসরি ভোটে না বরং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পরোক্ষ ভোটে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে প্রার্থীকে সাধারণত দুই ধরনের ভোটে জিততে হয়। এর একটি নাগরিকদের সরাসরি ভোট, যা ‘পপুলার ভোট’ হিসেবে পরিচিত; আরেকটি হচ্ছে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এই দুটির মধ্যে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটেই প্রার্থীর চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়।
এ ব্যবস্থায় প্রার্থীদের জয়-পরাজয় জাতীয়ভাবে না হয়ে নির্ধারিত হয় একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো অঙ্গরাজ্যে পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন।
চার বছর আগে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হেরেছিলেন। ওই নির্বাচনে বাইডেন ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হন। হেরে যাওয়া ট্রাম্প পেয়েছিলেন ২৩২টি ইলেকটোরাল ভোট।
বাইডেন আট কোটি ১২ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। এর বিপরীতে ট্রাম্প পেয়েছিলেন সাত কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোট। কিন্তু এর আগেরবার ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেলেও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে হেরে পরাজিত হয়েছিলেন।
কী এই ‘ইলেকটোরাল কলেজ’?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে একদল কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করে থাকেন, তাদের বলা হয় ইলেকটর। এই ইলেকটররাই নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। একটি রাজ্যের ইলেকটরদের একসঙ্গে ইলেকটোরাল কলেজ বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) দেশটিতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫১টি। এই ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে।
এক একটি রাজ্যে ইলেকটরের সংখ্যা একেকরকম। এটি নির্ধারিত হয় মার্কিন কংগ্রেসে রাজ্যের কতজন প্রতিনিধি ও সিনেটর আছেন সে হিসেবে। জনসংখ্যার ওপর রাজ্যগুলোর প্রতিনিধির সংখ্যা নির্ভর করে, প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারির মাধ্যম এটি নির্ধারণ করা হয়। এতে ১০ বছর পর পর অঙ্গরাজ্যগুলোর ইলেকটরের সংখ্যারও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।
সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দুই কক্ষে থাকা আসনের (প্রতিনিধি পরিষদে ৪৩৫, সেনেটে ১০০) বিপরীতে রাজ্যগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত ইলেকটর পায়। কংগ্রেসে রাজধানী অঞ্চল ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও সেখান থেকে আসেন তিনজন ইলেকটর।
নির্বাচনের দিন ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিলেও আসলে তারা ৫১টি ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত করে তাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে এই ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হয়। অর্ধশত রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই হাতে আসে হোয়াইট হাউজের চাবি।
ভোটের ফল কখন পাওয়া যাবে?
প্রতিটি ভোট গণনা করতে কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে। তবে সাধারণত যেদিন ভোট হয়, তার পরের দিন সকালেই জয়ী কে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
জয়ী প্রার্থী দায়িত্ব নেবেন কখন?
নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আগের প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হবেন, তা নয়। কারণ, নতুন নেতাকে মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী নিয়োগ করা এবং অন্যান্য পরিকল্পনার জন্য কিছুটা সময় নিতে হয়। এরপরই নতুন প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিতে পারেন। সাধারণত এই শপথ হয় ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে।
(ঢাকাটাইমস/০৪নভেম্বর/এমআর)
মন্তব্য করুন