সমাজসেবার অগ্রদূত রণদা প্রসাদ সাহা: স্মৃতিতে ও শ্রদ্ধায়

কাজী লতিফুর রেজা
  প্রকাশিত : ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০২
অ- অ+

কার্তিকের মৃদু ঠান্ডা বাতাস উড়ে আসছে গারো পাহাড় থেকে। আর শালবন থেকে ভেসে আসছে সাঁঝের নিঃশব্দতায় শিয়াল, প্যাঁচার ডাক । সন্ধ্যার ম্লান আলো ঢেকে গিয়েছে উত্থান একাদশীর শুক্লাপক্ষের দুকূল ভাসানো জ্যোৎস্নায়, সাভারের নিস্তব্ধ এক গ্রাম–কাছৈড়। জীর্ণ আঁতুড়ঘরে রাতের আঁধার বিদীর্ণ করে, কাকডাকা জ্যোৎস্নায় জন্ম নেন একজন রণদা প্রসাদ সাহা। কাছৈড় গ্রাম ছিল তাঁর নানার বাড়ি। সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী, মেয়েদের সন্তান জন্মের সময় বাপের বাড়িতে পাঠানো হতো। যদিও ক্ষুদ্র ব‍্যবসায়ী বাবা দেবেন্দ্র নাথের সামর্থ্য ছিল না স্ত্রীকে নিজের কাছে রাখার। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে রণদা ছিলেন মেজো। মা কুমুদিনী দেবীর গভীর স্নেহে বড় হয়ে উঠলেও সেই মায়ের সঙ্গটুকুও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সাত বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি। তাঁর মা অনাদরে, অবহেলায়, আঁতুড়ঘরের অশুচি পরিবেশে, বিনাচিকিৎসায়, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনি মারা যান। তাঁর মায়ের মৃত্যু ছিল হৃদয়বিদারক, যদিও তৎকালীন সমাজের রীতিতে এমন মৃত্যু এরকম অগ্রাহ্যই করা হতো।

এ শোক যেন তার জীবনজুড়ে এক বিস্তীর্ণ বনস্পতির পতনের মতো ছিল, যার শূন্যতা কোনোদিনও মেটেনি। মায়ের মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে সেই শূন্যতা তার হৃদয়ে গেঁথে যায়।

মায়ের অকালমৃত্যুর আঘাতই সম্ভবত তাকে পরিণত করেছে এক নিঃস্বার্থ প্রেমিক সমাজসেবীতে। তাঁর সেবা ও মানবকল্যাণের মূল চালিকাশক্তি ছিল মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা।

তৃতীয় শ্রেণির পর রণদার পড়াশোনা আর হয়ে ওঠেনি। বাড়িতে মন টিকেনি। কিশোর বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়েছেন বারবার। কুলি, শ্রমিক, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা— এমন হেন কোনো কাজ নেই যা তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ছিল না। তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণিলতা রূপালি পর্দার রোমাঞ্চকর মুহূর্তকে হার মানিয়েছে; হয়ে উঠেছেন আমাদের বাস্তবের নায়ক।

ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের বাইরে তার মধ্যে স্বদেশ ভাবনা উপলব্ধ ছিল। উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে, যা তার সাহসী মনোভাব এবং সংগ্রামী চেতনাকে আরও দৃঢ় করে তোলে। নিঃসংকোচে কারাবরণ করেন। জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, স্বদেশপ্রেমী, স্বশিক্ষিত এই মানুষটি ছিলেন সত্যিকারের মানবতার ফেরিওয়ালা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাগত, ব্রিটিশ ভারত থেকে যোগ দেন বেঙ্গল এম্বুলেন্স কোরে। ইরাকের মেসোপটেমিয়া ফ্রন্টে অসুস্থ ও আহত সৈনিকদের সেবা করেন আরো সবার সাথে । উনি যে তার কাজে আরো সবার থেকে আলাদা, ব‍্যতিক্রমী তা আবারও প্রকাশ পায়। একদিনের কথা। রোগীর তাঁবুতে আগুন লাগে গোলার আঘাতে। সে ভ‍য়াবহ আগুন ছিল অগম‍্য। আগুনের ভয়ে সবাই জীবন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন রণদা প্রসাদ দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে রোগীদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। শেষ রোগীটিকে বের করে এনে অজ্ঞান হয়ে গেলেন রণদা। বীরত্বগাথা ভূমিকার জন্য বিভিন্ন মহলে প্রশংসা অর্জন করেন। স্বীকৃতি লাভ করেন ব্রিটিশরাজ থেকে। তাঁর সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রণদাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

রণদা যখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে ইরাক যান তখন তাঁর সাথে দেখা হয় লম্বা চুল, বড় চোখের প্রাণবন্ত এক যুবক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। রণদা তাঁকে সংগীত বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যা নজরুলের বেশ পছন্দ হয়।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে বাঙালি পল্টনে যোগ দেন এবং সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিজের অসাধারণ দক্ষতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ করেন এবং পরবর্তীতে স্বদেশী তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দেশে ফিরে আসেন।

যুদ্ধ শেষে রেলওয়ের টিকিট কালেক্টরের চাকরি শুরু করেন। এই ক্ষুদ্র চাকরি ও মাপা জীবন, তোলা জলে তৃষ্ণা মেটানোর মানুষ তিনি ছিলেন না। যদিও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও বৃহৎ ও প্রসারিত।

তিনি কলকাতায় কয়লা ও লবণের ব্যবসা শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কয়লার একজন বড় ঠিকাদার এবং ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এই সময়ে নদীপথে কয়লাচালিত লঞ্চের মালিক হওয়ার মাধ্যমে তার আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। তার প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের মাধ্যমে তিনি দেশের নৌপথে মালামাল পরিবহনের একটি নতুন যুগের সূচনা করেন। এই বিপুল বিত্ত-বৈভব তাঁকে বিলাসী করে তুলেনি। বিশাল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি যথেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেননি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাঁকে আর সবার মতো রূঢ় হতে শেখায়নি। বরং সংসার সন্ন্যাসী মানুষটির মনে ছিল চির বৈরাগ্য। জীবন তাঁকে নিতে নয়, ভালোবেসে বিলিয়ে দিতে শিখিয়েছে, আর তিনি বিলিয়েও দিয়েছেন। এর সাক্ষ্য বহন করে কুমুদিনী ট্রাস্ট। সমাজকল্যাণের এই মহৎ প্রয়াসে রণদা প্রসাদ সাহা দেশের বিভিন্ন দুর্যোগময় মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশাল হৃদয়ের মানুষটি, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট গঠন করে তাঁর সমগ্র সম্পত্তি দাতব্য কাজে বিলিয়ে দিয়েছেন।

সমাজসেবা এবং মানবকল্যাণে তার অবদান অবর্ণনীয় ও চিন্তার অতীত। ১৯৩৮ সালে, অজপাড়াগাঁয়ে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাসপাতাল গ্রামের দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করে আসছে। তিনি শুধু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাই করেননি, কুমুদিনী হাসপাতালের সঙ্গে নার্স প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহিলাদের জন্য মেডিকেল কলেজ এবং অসহায় নারীদের জন্য ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠা করে তাদের শিক্ষা ও সেবাদানে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার এসব প্রচেষ্টা ও প্রতিষ্ঠা, তার শৈশবের তাড়িত স্মৃতির স্মারক।

রণদা প্রসাদ সাহা শুধুমাত্র একজন সফল ব্যবসায়ী বা সমাজসেবক ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানবতার অমলিন প্রতীক। সমাজের প্রতি তার অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে 'রায় বাহাদুর' খেতাবে ভূষিত করে এবং পাকিস্তান সরকার তাকে 'হেলাল-এ-পাকিস্তান' সম্মান প্রদান করে। তার মহৎ কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ৭ মে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা তাকে ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে মির্জাপুর থেকে ধরে নিয়ে যায়, এর পর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

ব্যবসায়ী, বিদ্যোৎসাহী ও সমাজসেবার পাশাপাশি রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন সংস্কৃতিপ্রাণ একজন মানুষ। অন্যের মধ্যে শিল্প ও সংস্কৃতির গুণ দেখলে তিনি যেমন তা উস্কে দিতেন, তেমনি নিজেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুরু থেকেই ভারতেশ্বরী হোমসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মির্জাপুরে বিপুল উৎসাহ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সৌখিন নাট্যসংঘ ও মঞ্চ। এমন আধুনিক মঞ্চ তখন পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায়ও ছিল না। ১৯৬৯ সালের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর দুই দিন আনন্দ নিকেতন মঞ্চে ক্ষীরদাপ্রসাদ রচিত 'আলমগীর' নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে বাদশাহ আলমগীরের ভূমিকায় রণদা প্রসাদের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।

এমন মহান ব্যক্তিত্ব রণদা প্রসাদ সাহা। যিনি নিজের জীবনের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যকে অগ্রাহ্য করেছেন। মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। তার এমন দানের গল্প রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছেন আমাদের অনুপ্রাণ, আমাদের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। তাঁর জীবনালেখ্য আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য জাজ্বল্যমান অনুপ্রেরণার উদাহরণ।

১৫ নভেম্বর এই নির্মোহ মানুষটির জন্মদিন। নাম-খ‍্যাতি, অর্থ-বিত্ত কোনো কিছুরই মোহ তাঁর ছিল না। নিজের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানও করেননি। তাঁর সুধন‍্য উত্তরাধিকাররা তাঁর নামে নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন আর. পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়।

তাঁর জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও মানবাধিকার বিভাগ, আর. পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ঢাকার বাতাস আজ খুব অস্বাস্থ্যকর
সাকিবের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে গল মারভেলসের জয়
কিশোর মুক্তিযোদ্ধার প্রাণের বিনিময়ে আজ পাক হানাদার মুক্ত হয় শ্রীপুর
যাকে সবচেয়ে বেশি পাশে পেয়েছি, তাকেই ‘র’ এজেন্ট বলছেন: আসিফ মাহমুদ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা