দেশে দেশে আদানিকে নিয়ে যত বিতর্ক

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪২| আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:২৫
অ- অ+

গৌতম আদানি শুধু ভারতেই নয়, সারাবিশ্বেই এখন আলোচিত ও বিতর্কিত এক ধনকুবের। বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া; নানাকাণ্ডে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে রয়েছেন আদানি। একদিকে তার রয়েছে, বিপূল সম্পদের প্রাচুর্য, আরেকদিকে তাকে ঘিরে প্রচণ্ড বিতর্ক।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত গৌতম আদানি। ২০১৪ সালে মোদিকে প্রথমবার দিল্লির মসনদে বসানোর জন্য, আদানি কাড়ি কাড়ি অর্থ ঢেলেছিলেন অভিযোগ রয়েছে। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতা নেওয়ার পরই ফুলেফেপে উঠতে থাকে আদানির ব্যবসা।

মোদির আমলের ব্যবসা এতটাই বেড়ে যায় যে, দুনিয়ার শীর্ষ ধনকুবেরদের তালিকায় ঢুকে পড়েন গৌতম আদানি। ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে বিভিন্ন মহাদেশে। বর্তমানে প্রায় ৭০টি দেশে রয়েছে আদানি গ্রুপের ব্যবসা।

তবে প্রকাশ্য হিসাবের বাইরে দেশে দেশে গোপনেও রয়েছে আদানিদের সম্পদের পাহাড়। মরিশাস এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো ট্যাক্স হেভেন হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর বিভিন্ন কোম্পানিতে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে।

বিতর্কিত এই গৌতম আদানির ব্যবসা ছড়িয়েছে নানা খাতে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি-বন্দর থেকে কৃষি, আবাসন, আর্থিক পরিষেবা; এমনিক প্রতিরক্ষা, মহাকাশ ও মিডিয়াতেও রয়েছে আদানি গ্রুপের বিপুল বিনিয়োগ।

তবে গৌতম আদানি যেখানেই গেছেন, সেখানেই দানা বেধেছে নানা বিতর্ক ও কেলেঙ্কারি। আর্থিক অনিয়ম, বিশেষ করে ঘুষ লেনদেন এবং প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসা নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগের মুখে বারবার পড়ছে হয়েছে গৌতম আদানিকে।

অষ্ট্রেলিয়ায় খনি থেকে কয়লা উত্তোলন নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে আদানিকে নিয়ে। একই বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলছে ভারতেও। তবে সবশেষ গত নভেম্বরে আদানিকে নিয়ে বড় ঝামেলা হয়, আফ্রিকার দেশ কেনিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট, বিতর্কিত এই ভারতীয় ধনকুবেরের সঙ্গে হওয়া, দুটি বড় চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন।

আর কেনিয়ার ওই ঘটনার ঠিক একদিন আগেই, আদানির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগের সিদ্ধান্ত নেন মার্কিন প্রসিকিউটররা। তার বিরুদ্ধেথ জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।

বাংলাদেশেও গৌতম আদানিকে নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। বিদ্যুৎখাতে বিতর্কিত এক চুক্তি নিয়ে বেশ বিপাকে রয়েছে আদানি গ্রুপ। দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে শেখ হাসিনার সরকার, আদানির সঙ্গে ওই চুক্তি করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার।

২০১৭ সালের নভেম্বরে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের ২৫ বছরের চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেখানকার ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়।

চুক্তির সময় ফাঁক রাখা হয় একটি বিষয়। তা হলো সম্পূর্ণ আমদানি করা কয়লায় পরিচালিত এই পাওয়ার প্ল্যান্টটিকে ২০১৯ সালের মার্চে ভারত সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে কর ছাড় দেয়। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির সময় কর ছাড়ের বিষয়টি গোপন করে আদানি গ্রুপ।

এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আদানিকে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। আমদানি করা কয়লার দামও বেশি ধরেছে আদানি। এসব কারণে বেড়ে যায় বিদ্যুতের দাম, যার সরাসরি সুফলভোগী হয় ভারতীয় ব্যবসায়ী গ্রুপটি।

শেখ হাসিনার সরকার আদানির সঙ্গে চুক্তি করার পরই, এ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক-সমালোচনা। কিন্তু কার্যত তখন কিছুই করা হয়নি।

গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে বেশ বিপাকে পড়েছে আদানি গ্রুপ। ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, আদানির চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।

বাংলাদেশে নিজেদের পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভিন্ন পথে হাটতে শুরু করেন গৌতম আদানি। বকেয়া পরিশোধ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ ভারতীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি।

তবে বাংলাদেশে তাদের ব্যাবসা গোটানোর শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। আর একথা ভেবেই, ভারতের ঝাড়খন্ডের যে কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো, আদানির সেই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রির সুবিধা করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।

আদানি ও শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে বিতর্কিত এই চুক্তি হয়েছিলো টেন্ডার ছাড়াই। বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সেই চুক্তি অব্যাহত থাকবে কি-না, তা এখনো নিশ্চিত না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা হওয়ার পর, আশংকা আরো বেড়েছে।

আদানিরা ব্যাপকভাবে প্রথম আলোচনায় আসেন ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। সেসময় এক সপ্তাহেই আদানির সম্পদ কমে যায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। এর কারণ ছিলো নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চের একটি প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই হুহু করে কমতে শুরু করে গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের মূল্য।

হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, কর্পোরেট জগতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজির ঘটনায় জড়িত আদানি। তাদের বিরুদ্ধে শর্ট-সেলিং-য়ের অভিযোগ ওঠে।

ওই প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাপক ঋণ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয় যে, ভারতে লেনদেন হওয়া শেয়ারের মূল্য নিজেদের পক্ষে নির্ধারণ করার জন্য, অফশোর কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করে আদানি।

কেনিয়াতেও আদানিদের বিরুদ্ধে উঠেছে ভয়াবহ অভিযোগ। আদানি গ্রুপ কেনিয়ার প্রধান বিমানবন্দরে প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল।

চুক্তি ছিলো যে, তারা সেটি ৩০ বছরের জন্য পরিচালনা করবে। এছাড়া, বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাথে ৭৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও একটি চুক্তি ছিল।

তবে আদানির চুক্তিগুলো খুব একটা পছন্দ করেনি কেনিয়ার মানুষ। দুর্নীতির আশঙ্কাও জমাট হয়ে ওঠে। কেনিয়ায় আদানিদের বিরুদ্ধে শুরু হয় ধর্মঘট। এক পর্যায়ে কেনিয়া থেকে বিতাড়িত করা হয় বিতর্কিত আদানিদের।

তবে এই চুক্তি বাতিলের মাত্র একদিন আগে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে বিরাট পদক্ষেপ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষের পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয় এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।

বরাবরেই মতো সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে আদানি গ্রুপ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিকিউটরদের আনা অভিযোগ, আদানিরা এবার উড়িয়ে দিতে পারবেন কি-না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

(ঢাকাটাইমস/১২জানুয়ারি/আরবি/ডিএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আদানির ঘুষকাণ্ড: তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া একাট্টা সব বিরোধী দল
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা