শিক্ষার্থীদের পুষ্টি নিশ্চিতে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার খাদ্য সরবরাহ করবে সরকার

শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করতে এবং অপুষ্টি হ্রাস করার লক্ষ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার খাদ্য সরবরাহ করবে সরকার, যা শিক্ষার্থীদের ভর্তি হার এবং উপস্থিতি বৃদ্ধি করবে। একই সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা সফলভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করবে এ কর্মসূচি।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ সংক্রান্ত কর্মসূচি অনুমোদন করা হয়েছে।
রবিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক চেয়ারপারসন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৪৫২ দশমিক ৪২ কোটি টাকার এই কর্মসূচির অনুমোদন দেওয়া হয়।
সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
উপদেষ্টা বলেন, “স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের লক্ষ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হার এবং উপস্থিতি বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা সফলভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করা।
তিনি জানান, এই কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১৫০টি উপজেলার ১৯৪১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৩.১৩ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসে পুষ্টিকর খাবার ফোর্টিফাইড বিস্কুট, কলা/মৌসুমী ফল, বান (পাউরুটি), ডিম এবং ইউএইচটি দুধ (পাস্তরিত দুধ) দেওয়া হবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই জাতীয় শুকনো খাবার বিতরণের সময় কঠোর ব্যবস্থাপনা ও তদারকি নিশ্চিত করা হবে, যাতে স্থানীয় বাজারে স্বার্থান্বেষী মহল এই ধরনের খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করতে না পারে।”
শিক্ষার্থীরা যাতে সঠিকভাবে খাদ্যসামগ্রী পায় সেজন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের যথাযথভাবে কর্মসূচিটি পর্যবেক্ষণ করতে নির্দেশনা দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
উপদেষ্টা আরও বলেন, “এই ধরনের কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে, শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া সমস্যার সমাধান করবে এবং এর ফলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে রাখা সম্ভব হবে।”
সভায় আরো যেসব প্রকল্প পাস
ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “সভায় মোট ২১ হাজার ১৩৯ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ মোট ১৫টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। মোট প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ১৪ হাজার ১৯৩ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের অংশ থেকে, ৬৫৩৯ দশমিক ২৯ কোটি টাকা প্রকল্প ঋণ হিসেবে এবং বাকি ৪০৬ দশমিক ৫৯ কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে আসবে।
অনুমোদিত ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি নতুন এবং আটটি সংশোধিত প্রকল্প বলে জানান ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
তিনি জানান, আটটি বিভাগের ৬২টি জেলার ১৫০টি উপজেলার প্রকল্প এলাকাগুলো গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর মাধ্যমে দারিদ্র্য ম্যাপিংয়ের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়েছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে সরকারি মালিকানাধীন জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন জমির প্রকৃত আয়তন নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদের মতো বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় খাস জমির পাশাপাশি বিশাল জমি রয়েছে উল্লেখ করে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “উপযুক্ত স্থানে অবস্থিত ও লাভজনক এসব জমি চিহ্নিত করে জমিতে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও, বিভিন্ন শিল্পনগরী, বিসিক, বন্ধ পাটকল ও চিনিকলের অব্যবহৃত জমি রয়েছে এবং প্রয়োজনে সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।”
তিনি জানান, পরিকল্পনা কমিশন ভূপৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত নদী অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে পারে।”
পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় চলতি বছর করতোয়া, ভাগড় ও তিতাসসহ দেশের প্রায় ১০টি নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে এবং এই নদীগুলোকে দখলদারমুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, “পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) আরও শক্তিশালী করা হবে এবং বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি অনলাইনে প্রকাশ করা হবে।”
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “সরকারি ক্রয় নীতিমালার সংশোধনী সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে, যার ফলে দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
তিনি আরও জানান, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী দিনে প্রকল্পের অধীনে দরপত্র প্রক্রিয়া শতভাগ অনলাইনে করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্পের সংশোধিত প্রকল্পটি শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে রাজধানীর পানির চাহিদার কোনো টেকসই সমাধান হবে না, বরং ভূপৃষ্ঠের পানি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে।”
পায়রা সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনের কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “প্রকল্পটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ‘মারাত্মক টিউমার’ ছিল। কারণ এখানে নদী বন্দরের সম্ভাবনাও নেই, সেখানে সমুদ্রবন্দর করার স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা।”
তিনি বলেন, “বন্দরের পাশের চ্যানেলটি অনেক দীর্ঘ এবং সেখানে নাব্যতা বজায় রাখার জন্য প্রতি বছর খনন কাজ করা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।”
সভায় অনুমোদিত অন্যান্য প্রকল্পগুলো হল: অতিরিক্ত ৯১১.১৯ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ দ্বিতীয় সংশোধিত পায়রা সমুদ্র বন্দরে প্রথম টার্মিনাল ও আনুষঙ্গিক সুবিধা নির্মাণ, অতিরিক্ত ৮১.৮৮ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ প্রথম সংশোধিত চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রায় ২,১৫৪.৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর কালুরঘাট এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ এবং ৫৩.৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকায় জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজিত জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ।
অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে আট হাজার ৪৯৬ দমমিক ৮০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে দ্বিতীয় সংশোধিত সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার, পর্যায়-৩, ৩৯৭ দশমিক ০১ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্র (দ্বিতীয় সংশোধিত), ০.০১ কোটি টাকা হ্রাসকৃত ব্যয়ে তৃতীয় সংশোধিত ডিজিটাল সংযোগ জোরদার করার লক্ষ্যে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের উন্নয়ন, ১০৭৬ দশমিক ০৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে প্রথম সংশোধিত, পঞ্চবটি থেকে মুখতারপুর সেতু পর্যন্ত দ্বিতল রাস্তা প্রশস্তকরণ ও নির্মাণ, প্রায় ১ হাজার ২৯৩ দশমিক ৩১ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন, ৫৩ দশমিক ৩৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে দ্বিতীয় সংশোধিত ঢাকা মহানগর সংলগ্ন ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন, প্রায় ২৫৫ দশমিক ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশব্যাপী ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্য গুদাম এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার, প্রায় ৬৮ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রেকর্ড রুম রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার, প্রায় ৬৯ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রমাণিত ষাঁড় উৎপাদন এবং ৭৭৫ দশমিক ২৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে দ্বিতীয় সংশোধিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভৌত সুরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ।
সভায় তিনটি প্রকল্পের জন্য চতুর্থবারের মতো সময় বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা কর্তৃক ১৩টি প্রকল্পের পূর্ব অনুমোদন সম্পর্কে একনেক সভায় অবহিত করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট সচিবরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
(ঢাকাটাইমস/২৪মার্চ/এফএ)

মন্তব্য করুন