গরমে শরীর ঠান্ডা রাখে বেলের শরবত, রোগ নিরাময়েও সিদ্ধহস্ত

বাংলাদেশের দারুণ জনপ্রিয় পুষ্টিগুণের ভান্ডার বেল। গরমে ঠাণ্ডা এক গ্লাস বেলের শরবত নিমেষেই প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি নানা রোগের উপশম ঘটাতে বেলের জুড়ি নেই। বাংলাদেশ ও ভারতের পল্লী অঞ্চলে সর্বত্র বেল পাওয়া যায়। এর ইংরেজি নাম বেঙ্গল কুইন্স। বৈজ্ঞানিক নাম ঈগল মারমেলস।
বেলের রয়েছে বহু ওষধি গুণ। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়াম। এছাড়া ভিটামিন এ, বি, সি, বিভিন্ন খনিজ এবং ফাইবারসহ প্রচুর পুষ্টিপদার্থ রয়েছে। এই ফল হজমের জন্য ভাল এবং কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্লতা, অনিয়মিত পেট সাফ জাতীয় পেটের সমস্যার ক্ষেত্রে উপকারী।
ভরপুর অ্য়ান্টি অক্সিড্যান্ট রয়েছে এতে। নানা ভিটামিনেরও খনি। একাধিক খনিজ পাওয়া যায় বেলে। মিলবে পর্যাপ্ত কার্বোহাইড্রেটও। ভারতের প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বেলের ওষধিগুণের কথা বারবার বলা হয়েছে। একাধিক রোগের চিকিৎসাতেও বেলের উপাদান প্রয়োগের কথা রয়েছে।
পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্রতি ১০০ গ্রাম আহার উপযোগী বেলে খাদ্যশক্তি আছে ৮৭ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৭৭ দশমিক ৫ গ্রাম, শর্করা ১৮ দশমিক ৮ গ্রাম, আমিষ ২ দশমিক ছয় গ্রাম, চর্বি শূন্য দশমিক ২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৮ মিলিগ্রাম, লোহা শূন্য দশমিক ৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১ শূন্য দশমিক শূন্য ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ শূন্য দশমিক শূন্য ২ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন সি ৯ মিলিগ্রাম।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বেল বমি, রক্তবমি, অধিক রক্তক্ষরণ, বাচ্চাদের বিছানায় প্রসাব করা, ডায়াবেটিস, ব্রংকাইটস, অ্যাজমা, পানিবসন্ত ও মাড়ি প্রদাহের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
বেল প্রস্টোজেন হরমোন লেভেল বাড়িয়ে নারীদের ইনফার্টিলিটির ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া প্রসব-পরবর্তী ডিপ্রেশন কমাতেও খুবই কার্যকরী।
হোমিওপ্যাথিতে বেলের পাতা ও ফল থেকে দু'টি মূল্যবান ওষুধ তৈরি হয়। পাতা থেকে তৈরি ওষুধটির নাম ঈগল ফোলিয়া। ঈগল ফোলিয়া আন্ত্রিক সমস্যায়, বিশেষভাবে আমাশয়, পাইলস, কোষ্ঠবদ্ধতায় বেশ কার্যকর। বেলফল থেকে তৈরি ওষুধটির নাম ঈগল মারমেলস। আমাশয়, কোষ্ঠবদ্ধতা, ঠাণ্ডা প্রবণতা, কোমরে ব্যথা, স্বপ্নদোষ, চক্ষুপ্রদাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ উপকারী।
প্রাচীন সময় থেকেই কিন্তু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পাকাপক্ত জায়গা করে করে নিয়েছিল বেল। তাই বেল খেয়ে থাকুন সুস্থ। চলুন জেনে নিই নিয়মিত বেল খাওয়ার উপকারিতা এবং এর মাধ্যমে যেসব রোগ এড়ানো যায়-
ডায়াবেটিস কমায়
পাকা বেলে আছে মেথানল নামের একটি উপাদান যা ব্লাড সুগার কমাতে কাজ করে। তবে ভালো ফল পেতে পাকা বেল শরবত করে নয়, এমনিই খেতে হবে।
কিডনি ভাল থাকে
বেলের উপাদান কিডনি সুস্থ রাখে। কিডনির কার্যকারিতা ঠিকমতো চালাতে সাহায্য করে বেলের উপাদান।
ডায়রিয়া কমায়
কাঁচা বেল ডায়েরিয়ার জন্য অব্যর্থ ওষুধ। যদি অনেক দিন ধরে আপনি এই সমস্যায় ভোগেন তাহলে বেল খান। কাঁচা বেল স্লাইস করে কেটে রোদে শুকিয়ে নিন। তারপর তা গুঁড়া করে নিন আর এই গুঁড়া ১ চামচ নিয়ে ব্রাউন সুগার আর গরম পানিতে মিশিয়ে খান। দিনে দুই বার খেতে হবে এই পানি। আর ফল পেতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়
বেল মল পরিষ্কার হতে সাহায্য করে। নিয়মিত রোজ টানা ৩ মাস যদি আপনি বেলের শরবত খেতে পারেন তাহলে আপনার মল আর কঠিন থাকবে না। কোষ্ঠকাঠিন্য আর হবে না। পাকা বেলের শাঁস বের করে চিনি আর পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে খান।
পেপটিক আলসারের ওষুধ
পাকস্থলীর আলসার, পাইলস রোগে উপকারী। এটি শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে। পাকা বেলের শাঁসে সেই ফাইবার আছে যা আলসার উপশমে সাহায্য করে। সপ্তাহে তিন দিন বেলের শরবত করে খান আলসার কমাতে। এছাড়া বেলের পাতা সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সেই পানি খেলেও কিন্তু অনেক কমে যায় আলসার।
যক্ষ্মা কমায়
পাকা বেলে আছে অ্যান্টি মাইক্রোবায়াল উপাদান, যা যক্ষ্মা কমাতে সাহায্য করে। তবে ভালো ফল পেতে আপনাকে ব্রাউন সুগারের সঙ্গে বা মধু দিয়ে বেলের শরবত করে রাতে খেতে হবে শুতে যাওয়ার আগে। এটি টানা চল্লিশ দিন খান। উপকার পাবেন।
ক্যানসার দূরে রাখে
বেলে আছে অ্যান্টি প্রলেফিরেটিভ ও অ্যান্টি মুটাজেন উপাদান। এই উপাদান টিউমার হতে দেয় না সহজে। আর যেহেতু এই ফলে হাই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান আছে তাই ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
ম্যালেরিয়া কমায়
ম্যালেরিয়া হলে কাঁচা বেল নিয়ে গুঁড়া করে নিন। এবার ১ চামচ এই বেল গুঁড়া নিয়ে তার সঙ্গে তুলসির রস নিন। সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেয়ে নিন দিনে দুইবার। এটি কিন্তু অসাধারণ উপকার করে।
রক্ত শুদ্ধ করে
রক্তের মাধ্যমেই পুষ্টিগুণ আমাদের শরীরের সব অংশে পরিবাহিত হয়। তাই রক্তের শুদ্ধ থাকাটা খুব দরকার। বেল এই রক্ত শুদ্ধ করতে খুব ভালো কাজ দেয়। খানিকটা পাকা বেলের রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে খেলে এটি রক্ত শুদ্ধ করে। ট্যান দূর করে। শুধু রক্ত নয়, কিডনি ও লিভারের কাজও ঠিক করে।
লিভারের যত্ন
বেল বিটা ক্যারোটিনের সমৃদ্ধ উৎস। আর বিটা ক্যারোটিন হল লিভার ভালো রাখার অন্যতম মূল চাবিকাঠি। বেলে আছে থিয়ামিন আর রাইবোফ্লেভিন। এই দুই উপাদানই লিভারের শক্তি বাড়ায় খুব ভালোভাবে।
ব্লাড প্রেসার কমায়
বেল আপনার ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখবে। সাধারণ যেমন বেলের শরবত খান সেভাবে খেলেই হবে। মিষ্টি এই শরবত কিন্তু আপনার এই চাপ থেকে আপনাকে অনেক দূরে রাখবে।
আমাশয় কমায়
অন্ত্রের কৃমিসহ অন্যান্য জীবাণু ধ্বংস করে ডায়রিয়া এবং আমাশয় রোগে খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। আমাশয় হলে কচি বেল টুকরো করে কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখুন সারা রাত। সেই পানি পরের দিন ছেঁকে নিয়ে খান। দেখবেন এতে খুব ভালো ফল পাবেন।
ত্বক ভালো রাখে
ত্বককে সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে বেলের শাঁস এবং ত্বকের স্বাভাবিক রং বজায় রাখে। বেলের রসে রয়েছে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে বলে বেল খেলে ত্বকে ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসে, পাশাপাশি, বয়সের ছাপও খুব দ্রুত পড়ে না।
আর্থ্রারাইটিস কমাতে
ব্যাথা ছাড়া এখন খুব কম মানুষই আছেন।নিয়মিত বেল খেলেই মুক্তি পাবেন আর্থ্রারাইটিস-এর সমস্যা থেকে।
বেলের শরবত যেভাবে বানাবেন
উপকরণ
বেল: ১ টি মাঝারি আকারের
দুধ: ১ কাপ (সর্বাধিক শীতল)
চিনি/গুড়: স্বাদ অনুসারে
কালো / গোলাপি লবণ: ১.৫ চা চামচ
কাজু: ৫-৬ টা
কিসমিস: ১ চা চামচ
প্রণালি
পরিষ্কার পানি বেলটি ধুয়ে নিন এবং বাইরের শক্ত খোসাটি ছাড়িয়ে ফেলুন। একটি বড় বাটিতে চামচ চেঁছে বেলের মণ্ডটা তুলে নিন। বীজগুলো যতটা সম্ভব হাত দিয়ে সরিয়ে ফেলুন। বীজ পানীয়টিকে স্বাদে তেতো করে তোলে। এবার ওই মণ্ডের সঙ্গে কিছুটা পানি (আধ কাপের কম) যোগ করুন এবং ৫ মিনিট রেখে দিন। এতে মণ্ডটা নরম হয়ে যাবে। তবে যদি বেলটা পাকা এবং যথেষ্ট নরম হয় তবে না রাখলেও চলবে। হাত দিয়ে মণ্ডটিকে ভালো করে মেশান। মনে রাখবেন, শরবত তৈরি করতে আপনার একমাত্র সরঞ্জাম হ'ল আপনার হাত। এবার মণ্ডে দুধ, গুড়/ চিনি এবং গোলাপি/ কালো লবণ যোগ করুন এবং ভালভাবে মিশিয়ে ইফতারের সময় পরিবেশন করুন।
(ঢাকাটাইমস/২৮ এপ্রিল/আরজেড)

মন্তব্য করুন