পাগল খুঁজে ভালো করাই তার নেশা

মঞ্জুর রহমান, মানিকগঞ্জ থেকে
 | প্রকাশিত : ২১ মার্চ ২০১৭, ০৯:৩৬

রাস্তার পাশে ঘুরে বেড়ানো মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তার চেষ্টার জুড়ি নেই। এজন্য ঘুরে বেড়ান দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। মানবতার বিজয় ছিনিয়ে আনতে তিনি যেন এটিতে নেশায় পরিণত করেছেন। ভারসাম্যহীন মানুষ দেখলেই তাদের পরম মমতায় কাছে টেনে নেন। নিজ খরচে সুস্থ করে তোলার পর তাকে তুলে দেন পরিবারের হাতে। তার আপ্রাণ চেষ্টায় অনেক মানুষ পেয়েছে স্বাভাবিক জীবন। এমন কাজ করে যিনি মানুষের মাঝে বাঁচতে চান তিনি হলে শামিম আহমেদ। যিনি একজন ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত আছেন।

শামিম আহমেদের চেষ্টায় মানিকগঞ্জের অঙ্গাতপরিচয়ের এক মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণী অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। তার নাম পারুলী। দুই মাস আগে যিনি ছেঁড়া জামাকাপড় পড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, আজ তিনি পেয়েছেন নতুন জীবন। ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসার পর পারুলীকে ঢাকার আদাবর এলাকার জরিনা বেগম নামে এক নারীর তত্বাবধায়নে রেখে সম্পূর্ণ সুস্থ করেছেন ব্যাংকার শামিম আহমেদ। এখন পারুলী সবার সঙ্গে কথা বলছেন, হাসছেন, পরিবারের অনেকের নামও বলতে পারছেন।

বাড়ির ঠিকানা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও পারুলীর গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার চরদুয়ানীতে বলে মাঝে মাঝে বলেন তিনি। এখন পারুলীকে পরিবারের সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রতিক্ষায় আছেন শামিম আহমেদ।

শামিম ঢাকাটাইমসের এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, এ কাজটি করতে তার প্রচুর অর্থ খরচ হয়। এরপরও তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মহান কাজটি করে যেতে চান।

সেই তরুণী এই পারুলী

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঘিওর উপজেলার পুকুরিয়া বাসস্ট্যান্ড। এই বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী ছাউনীতে হঠাৎ আশ্রয় নেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণী। তার নামপরিচয় কেউ বলতে পারেন না। নিজের নাম পারুলী দাবি করলেও ওই সময় তাঁর কথাবার্তা ছিল অসংলগ্ন। ঠিকমত খেতে না পেয়ে অপুষ্টিতে ভোগা পারুলীর শারীরিক অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। অনেকেই তাকে দেখলেও কেউ তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসেনি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শামিমের কাজের খবর ছড়িয়ে পড়লে তার এক পরিচিতজন ওই তরুণীর সন্ধান দেন শামিমকে। খবর শোনামাত্র বন্ধু সাব্বিরকে নিয়ে ছুটে যান মানিকগঞ্জের পুকুরিয়া বাসস্ট্যান্ডে। এরপর ঘিওর থানা পুলিশের অনুমতি নিয়ে পারুলীকে উদ্ধার করে তাকে ভর্তি করান ঢাকার মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। এমন মহত কাজে পারুলীকে ঢাকায় নিতে শামিমকে অ্যাম্বলেন্স দিয়ে সহযোগিতা করেন ঘিওরের পশ্চিম শাহিলী একতা সমাজকল্যাণ সংস্থা।

ব্যাংকার শামিমের মানবিকতা

ব্যাংকার শামিম আহমেদের এমন মানবিকতার পরিচয় এটাই প্রথম নয়। এর আগে আরও দুইজন মানসিক প্রতিবন্ধী তরুণীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তাদের পরিজনের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাদের একজন নোয়াখালীর মাইজদী উপজেলার লক্ষ্মীনারায়নপুর গ্রামের রিকশাচালক আলাউদ্দীনের মেয়ে জবা। অন্যজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার দাওরিয়া গ্রামের সতীর্থ সরকারের মেয়ে শিউলী রানী সরকার। জবাকে ঢাকা থেকে আর শিউলী রানীকে বান্দরবনের থানচি থেকে উদ্ধার করেছিলেন। পারুলীর পর আরও বেশ কয়েকজন মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের নিজ খরচে চিকিৎসা করাচ্ছেন শামিম।

যেভাবে মহত কাজের শুরু শামিমের

ব্রহ্মণবাড়িয়া সন্তান শামিম আহম্মেদ। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে যমুনা ব্যাংকের ঢাকা হেড অফিসে আছেন। সেখানে তিনি আইসিটি ডিভিশনে সিনিয়র এক্সিকিউটিব অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চাকরির পাশাপাশি এ রকম মহত কাজের শুরু ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট। নিজ বাড়ি থেকে অফিসে যাবার পথে পল্টন মোড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণীকে দেখতে পান। ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন ওই তরুণীর নাম জানা ছিল না। প্রথমদিন তিনি তাকে কিছু কিছু খাবার কিনে দিতেন। এরপর অফিসে গিয়ে সহকর্মী আলী সাব্বিরের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন ওই তরুণীকে চিকিৎসা করাবেন। যোগাযোগ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এরপর পল্টন থানা পুলিশের সহায়তায় ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তাকে ভর্তি করান মানসিক হাসপাতালে। তখনো মানসিক প্রতিবন্ধী ওই তরুণীর পরিচয় তাদের জানা ছিল না। শামিদের দেয়া আদুরী নামেই তাকে ভর্তি করা হয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। কয়েকদিনের চিকিৎসাতেই আদুরী অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেন। ফিরে আসতে শুরু করেন স্বাভাবিক অবস্থায়। এরপর তার কিছু কিছু কথার সুত্র ধরে ফেসবুক ও পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় আদুরীর বাবাকে। আদুরী ফিরে পান তার বাবা,মাসহ আত্মীয়স্বজনদের। পরে পরিবার জানায় আদুরীর আসল নাম জবা।

এরপর বান্দরবানের থানচিতে বেড়াতে গিয়ে সেখানে গাছের নিচে মানসিক প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে দেখতে পান। এরপর পুলিশের সহায়তা নিয়ে তাকে অন্তরা নামে জাতীয় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করান। চিকিৎসা শেষে অন্তরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে তাকে ফিরে দেন পরিবারের কাছে।

মানসিক ভারসাম্যহীনদের সুস্থ জীবনে ফিরে আনার এমন মহত উদ্যোগের জন্য শামিম আহমেদ পেয়েছেন সম্মাননা স্মারক।

ব্যাংকার শামিম আহমেদ ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘মানবিক ও সামাজিক কাজগুলো সরকারের একার নয়। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে।’ তিনি বলেন, আমি ফেসবুকের মাধ্যমে আমার কাজের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাজগুলো দেখে অন্যরাও যেন অনুপ্রাণিত হয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের পাশে এগিয়ে আসে।

শামিম আহমেদ বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন এসব মানুষদের জন্য একটা হাসপাতাল নির্মাণ করাই আমার লক্ষ্য। এভাবে আমি মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই।

ঢাকাটাইমস/২১মার্চ/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :