প্রতারণার অসমাপ্ত কথা...

মনিরুল ইসলাম
| আপডেট : ০৭ জুলাই ২০১৭, ১৩:১৭ | প্রকাশিত : ০৭ জুলাই ২০১৭, ১২:০৮

হাসপাতাল ছেড়েছেন কয়েকদিন। করিম সাহেব কেমন যেন মনমরা। শরীরের উপর দিয়ে একটা ধকল গেছে। খোদেজা বেগম ভাবে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সহকর্মীরা কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। মলিন মুখে ভালো আছেন জবাব দেন। রাতে ঘুমাতে পারেন না। তিনি কি স্ত্রীকে সব খুলে বলবেন। জানাজানি হয়ে যাবে। মানুষ বোকা ভাববে। সবাই বিদ্রূপ করবে। স্বল্পভাষী খোদেজা তীর্যক মন্তব্য করবে। ছেলেমেয়ে মুখ টিপে হাসবে।

তাদের বাবা কি বোকা। করিম সাহেব সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। মাঝেমধ্যেই করিম সাহেব ওইসব নম্বরে সংযোগ পেতে চান। সব বারই ব্যর্থ, মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায় না। এভাবে আরো এক সপ্তাহ কেটে যায়। রাতে এপাশ-ওপাশ করেন। গভীর রাতে মশারি থেকে বেরিয়ে জানালায় দাঁড়ান। গভীর রাতে ট্রাক আর কাভার্ড ভ্যানের শব্দ।

খোদেজা বেগম সবই টের পান। স্বামী রাতে ঘুমান না। জিজ্ঞাসা করে সদুত্তর পায় না। বেশি প্রশ্ন করতে সাহসেও কুলায় না। এমনিতে করিম সাহেব গোবেচারা টাইপের মানুষ। তবে বড্ড অভিমানী। ভেতরে ভেতরে করিম সাহেব ক্লান্ত। খোদেজাকে সব খুলে বলবেন। পঁচিশ বছর বিয়ে হয়েছে। স্ত্রীকে কোন কিছু গোপন করেননি। খোদেজাই তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। দুই তিন দিন সংকল্প করেও বলা হয়ে ওঠে না। আজ যে করেই হোক বলবেন।

কখন বলা যায়? শুক্রবার, অফিস নাই। সারাদিন বাসায় থাকবে। আজই সুযোগ। ছেলেমেয়ে দুই জনই আজ বাসায়। ছোট্ট বাসা। সুযোগ হয় না। গভীর রাত। সব শুনে খোদেজা নির্বাক। বিশ্বাস হতে চায় না। বিয়ের পর স্বামীকে দেবতা মনে করে এসেছে। কখনো লোভী হতে দেখেনি। শেষের দিকে করিম সাহেবের কণ্ঠ ভারী হয়। পরম মমতায় স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। দু'জনেই চুপ করে থাকে।

অনেকক্ষণ পর খোদেজাই প্রথম কথা বলে। তার দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানায় আছে। পরেরদিন বাসা খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। অনেকদিন যোগাযোগ নাই। বশির দারোগা চুপচাপ শোনে। এতোটা বোকামো। বশিরের ভীষণ রাগ হয়। তার ইচ্ছা হয় ভগ্নিপতির গালে ঠাস করে চড় মারে। খালাতো বোনের সাথে সম্পর্ক খুব শীতল। তাই খুব একটা কথা হয় না।

শুষ্ক কণ্ঠে বশির মিয়া বাঁকা কথা শোনায়। খোদেজা অপমান বোধ করে। লজ্জ্বায় মুখ তুলতে পারেন না। বশিরের কথা শুনে করিম সাহেবের মনে হয় তিনিই প্রতারিত নন। তিনি নিজেই প্রতারণা করেছেন, অপরাধী। বশির মিয়ার কাছে এই গল্প পুরনো। আগেও এরকম তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে। কোনটারই প্রতিকার দিতে পারে নাই। কী করবে তা বুঝে উঠতেই পারেনি।

মোটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে বশির মিয়া থানায় যায়। মিনিট বিশেক পরে ফেরত আসে। আশার কথা শোনায়। ডিবির লোকেরা নাকি এরকম প্রতারক গ্যাঙ ধরতে পারে। বশির মিয়া টেলিফোনে তার ব্যাচমেটের সাথে কথা বলে। ব্যাচমেট সন্ধ্যার পর ডিবি অফিসে দেখা করতে বলে।

আবারও বিদ্রূপের মুখামুখি হতে হবে। করিম সাহেব মানসিক প্রস্তুতি নেন। বশির মিয়ার ব্যাচমেট করিম সাহেবকে নিয়ে তার বসের রুমে ঢুকেন। এসি সাহেবের বয়স কম। করিম সাহেবকে বসতে ইঙ্গিত করেন। ইতস্ততঃ করে করিম সাহেব সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়েন। বশির মিয়া আর তার ব্যাচমেট দাঁড়িয়ে থাকে।

এসি সাহেব প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো কাহিনি শোনেন। প্রতারকের নম্বর এবং বিকাশ নম্বরগুলো নোট করেন। তিনি দেখবেন বলে করিম সাহেবকে বিদায় দেন। বশির মিয়ার মোটর সাইকেলে করিম সাহেব বাসায় ফেরেন। এসি সাহেব তাকে কোন আশ্বাস দেননি। করিম সাহেব কিছুটা হতাশ।

এসি সাহেব তার এডিসিকে সঙ্গে নিয়ে ডিসির রুমে যান। ডিসি স্যার অভিজ্ঞ মানুষ। সব শুনে কিছু নির্দেশনা দেন। এই ধরনের অভিযোগ আরো কয়েকটা এসেছে। একটা কিছু করা দরকার। মানুষকে প্রতারিত করছে। অনেক মানুষের সঞ্চয় হাতিয়ে নিচ্ছে। এসি সাহেব মাঠে নামেন। এডিসির সরাসরি তত্ত্বাবধানে তথ্য-প্রযুক্তি বিশ্লেষন করেন। বুঝতে পারেন প্রতারকচক্র অনেক বেশি ধূর্ত। মোবাইলগুলোর রেজিস্ট্রেশন সব ভূয়া।

প্রতারকদের অবস্থান এলাকা চিহ্নিত করে ফেলেন। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যায় না এরা। স্থানীয় পুলিশের সহায়তা নিয়ে ধরে ফেলেন কয়েকজন প্রতারক। এরা খুব একটা শিক্ষিত নয়। কথায় খুব স্মার্ট। জিজ্ঞাসাবাদে অজানা তথ্য বেরিয়ে আসে। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার ফুটপাতে অনেক ধরনের ক্যানভাসার থাকত। কেউ তাবিজ, কেউ হালুয়া কিংবা কেউ বই বিক্রি করত। সম্ভাব্য ক্রেতা আকৃষ্ট করতে হতো।

ক্যানভাসারের বাচনিক দক্ষতার উপর বেচাবিক্রি নির্ভর করতো। এটাই ছিল তাদের জীবিকা। আস্তে আস্তে টেপ রেকর্ডার এসে যায়। ক্যানভাসারের জায়গা দখল করে টেপরেকর্ডার। ক্যানভাসারদের ব্যবসা গুটিয়ে যায়। ক্যানভাসারদের একটা বড় অংশ পেশা পরিবর্তন করে। ক্ষুদ্র একটা অংশ প্রতারণার পেশায় নেমে পড়ে। পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে টেলিফোনে কণ্ঠের যাদুতে মানুষকে কনভিন্সড করে। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে মানুষকে। পুরস্কারের প্রলোভনে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। ডিজিট দেখে অপেক্ষাকৃত পুরোনো নম্বরের গ্রাহক বেছে নয়। তারপর স্মার্ট কণ্ঠে কল দিয়ে পুরস্কার প্রাপ্তির খবর দেয়। অন্যের সাথে শেয়ার করলে শিকার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই চাতুর্যের সাথে কারো সাথে শেয়ার করতে নিষেধ করে।

প্রচারেই প্রসার-ফোন কোম্পানিগুলো এই নীতিতে বিশ্বাস করে। পুরষ্কার চালু করলে তা রেডিও-টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করবে। নানারকম বিজ্ঞাপন বানাবে। বারবার প্রচার করে কান ঝালাপালা করে ফেলবে। পোস্টার বিলবোর্ড বানাবে। পুরষ্কারতো গোপনে দেওয়ার কথা নয়। ফোন কোম্পানির হটলাইনগুলোতে ফোন করেও বিষয়টা যাচাই করা সম্ভব।

এই ধরনের ঘটনায় প্রতারককে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ। প্রতারক ধরা পড়লেও সাজা নিশ্চিত করা আরো কঠিন। টাকা ফেরত পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

প্রতারণা প্রাচীন পেশা। সতর্ক থাকুন। এধরনের অফার পেলে নিজে নিজে পর্যালাচনা করুন। অন্যদের সাথে আলোচনা করতে পারেন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার সচেতনতায় প্রতারক তার পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হবে।

লেখক: অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :