ফায়ার সার্ভিসকে আমাদের স্যালুট

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৩ আগস্ট ২০১৭, ২২:৫৩

প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে আমাদের অনেকে যখন নিরাপদ আশ্রয়ের তালাশে থাকি, তখন একদল মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্যোগের সাথে লড়াই করে বিপদাপন্নদের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি সম্পদ রক্ষার জন্য নিজেদের জীবনকে বিপদগ্রস্থ করেন। আগুন লাগুক কিংবা ভবন বা পাহাড় ধসে পড়ুক, এই সুপ্রশিক্ষিত মানুষগুলো অসম্ভব কে সম্ভব করতে নিজের জান বাজি রেখে কাজে নেমে পড়েন। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এর কথা বলছি। বাংলাদেশে হাতে গোনা যে কয়টি প্রতিষ্ঠানকে মনের থেকে স্যালুট দিতে ইচ্ছে করে, তাদের একটি এই প্রতিষ্ঠান। যখনই বিপদ, তখনই এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসে হাজির হয়। অন্যদের মত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করার সুযোগ এখানে নেই। গড়িমসি করার সুযোগ নেই।

বাংলা উইকিপিডিয়াতে লেখা আছে ‘বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স বাংলাদেশে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮২ সালে গতি, সেবা ও ত্যাগের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কার্যক্রম আরম্ভ করে। প্রথম সাড়া প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে এ বিভাগের কর্মীরা অগ্নি নির্বাপণ, অগ্নি প্রতিরোধ, উদ্ধার, আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে প্রেরণ ও দেশী-বিদেশী ভিআইপিদের অগ্নি নিরাপত্তা বিধান করে থাকে । উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনাকারী সংস্থা হিসেবে যা সব ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবিক দুর্ঘটনায় উদ্ধারকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে’। এ কথাগুলো শুধু উকিপিডিয়া নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি কৃতজ্ঞ মানুষের হৃদয়েও লেখা আছে। ফায়ার সার্ভিসকে হৃদয়ে না রেখে উপায় আছে? সর্বশেষ দেখা গেল, ফায়ার সার্ভিসের দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মীরা এগিয়ে এলেন ঢাকার জলাবদ্ধ মানুষের পাশে। ছোট ডিঙ্গি এনে মানুষকে রাস্তা পারাপারের কাজ শুরু করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

বৃষ্টিতে জলমগ্ন ঢাকায় রাস্তা পারাপারের জন্য লাইফ বোট সার্ভিস শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর শান্তি নগর এলাকায় এ চিত্র দেখা গেছে। নাগরিকদের বোটে উঠিয়ে টেনে পার করছেন ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা। নগরীর অন্যতম জলমগ্ন এলাকা শান্তিনগর। অল্প বৃষ্টিতেই এখানকার সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি জমে যায়। অনেক বছর ধরেই এ সমস্যায় ভুগছেন শান্তিনগরবাসী। রাজধানীতে গত তের বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে বৃহস্পতিবার। ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট ১৩৪ মি.লি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। আর আজ ঢাকায় ১২১ মি.লি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে বলে জানান আবহাওয়ায় অফিসের আবহাওয়াবিদ আনোয়ার হোসেন। বৃষ্টিতে হাঁটু থেকে কোমর পানিতে বিপাকে পড়েন রাস্তায় বের হওয়া মানুষজন। এদের রাস্তা পারাপারের জন্য নামানো হয় ফায়ার সার্ভিসের বোট।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানের মিশন সম্পর্কে বলা আছে ‘দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদ রক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা’। এই মিশন আমাদের সকলেরই হওয়া উচিত। কিন্তু সবাই কি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে? অন্যরা করুক না করুক, আমরা দেখতে পাচ্ছি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা করে যাচ্ছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির কথা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানব-সৃষ্ট দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মানবসেবার অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশ আর্মি, বাংলাদেশ পুলিশ, আনসারসহ সর্বস্তরের মানুষ সে জাতীয় দুর্যোগে আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগরসহ আশপাশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষ সে দুর্যোগে এসেছিল সে দুর্যোগে হতভাগ্য শ্রমিকদের উদ্ধার করতে। সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মানবসেবার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন।

আরও একদল মানুষ ছুটে এসেছিলেন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে দিনের পর দিন চাপা পড়ে থাকা মানুষগুলোকে জীবিত অথবা মৃত উদ্ধার করতে। তারা হলেন স্বেচ্ছাসেবকের দল। এই স্বেচ্ছাসেবকেরা যে রাষ্ট্রের কত বড় সম্পদ তা ভাবা যায়না। আপনাদের কি স্বেচ্ছাসেবক উদ্ধারকর্মী এজাজ উদ্দিন চৌধুরী কায়কোবাদের কথা মনে আছে? রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্যোগ চলাকালে সামরিক, ফায়ার সার্ভিস ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের সাথে স্বেচ্ছাসেবক কর্মী হিসেবে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন এজাজ। এজাজ একাই ১০ জন গার্মেন্টস কর্মীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন। এজাজ এমনই সাহসী ও দক্ষতা নিয়ে কাজ করেছিলেন যে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস তাদের সাথে এজাজকে নিয়ে নেয়। বলা যায়, এজাজ হয়ে উঠেছিলেন অন্য সবার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

শাহিনা নামের এক গার্মেন্টস কর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এজাজ। এরকম অনেক এজাজ সেই কঠিন বিপদের সময় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কাজ করেছিলেন। ফায়ার সার্ভিস এরকম হাজার হাজার এজাজ সৃষ্টি করার জন্য কর্মসূচী নিয়ে এগুচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছি? টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় মাঝে মাঝেই আমরা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীর বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ রিপোর্ট হতে দেখি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, ফায়ার সার্ভিসের সাহসী ও দক্ষ কর্মীরা এ তুলনায় প্রশংসা এবং প্রচার খুব বেশী পান না। অনেক সময় দেখা যায়, প্রাযুক্তিক সাপোর্টের অভাবে দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছোটখাট দুর্যোগেও দেখা যায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে কাজে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। সরকারের উচিত হবে ভবিষ্যতের কোনো বড় দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে এখনি প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি ক্রয় করে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখা। পাশাপাশি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও তাদের পরিবারের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :