গরুর রক্ত, আন্দোলন এবং মাহমুদুর রহমান

মাহবুব রেজা
 | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০১৮, ১১:৫৫

তখন আওয়ামী লীগ সরকারি দলে। বিএনপি রাজপথে আন্দোলনে ছিল, সে সময়ের কথা। সম্ভবত ২০০০ সালের কথা। ঢাকার মেয়রের দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন সাদেক হোসেন খোকা। সে সময় একটি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয়া সংঘর্ষে খোকার মাথা ফেটে গিয়ে রক্তে একাকার হয়ে যাওয়া একটি ছবি দেশের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। পরদিন পত্রিকার পাতায় সাধারণ মানুষ খোকার সেই রক্তে মাখা ছবি দেখে স্বাভাবিকভাবেই শাসক দলের প্রতি বৈরী হয়ে উঠেছিল। তখন খোকার এ ছবি নিয়ে সরকারি দলও ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। সে পরিস্থিতিতে তখন সরকারের ভেতর এবং বাইরের বিভিন্ন মহলে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হলো একজন নির্বাচিত মেয়রের নিরাপত্তাকর্মী, নিজ দলের সমর্থক ও দেহরক্ষীদের ভেতর কে বা কারা মেয়রের মাথা ফাটিয়ে এরকম রক্তাক্ত করল! খোকার সেই রক্তমাখা ছবি দিয়ে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল গোটা শহরের দেয়াল। পরবর্তীতে অবশ্য একাধিক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছিল সাদেক হোসেন খোকার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া সেই রক্তমাখা ছবির শানে- নজুল। জানা গিয়েছিল তৎকালীন মেয়র সাহেবের মাথা ফেটে গড়িয়ে পড়া রক্ত নাকি গরুর রক্ত!

অভিজ্ঞজনরা বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করা হবে। জেলে ঢোকানো হবেÑ তাদেরকে রক্তাক্ত করা হবে এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তারা বলছেন, এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রকৃতি, গতিধারা ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ ছিল। শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের সংগ্রামের ধারা এরকমই ছিল। কালের বিবর্তনে দৃশ্যপট অনেক বদলেছে। বিরোধীদের আন্দোলন-সংগ্রামের কৌশলের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। হয়তো সেই পরিবর্তনের ধাক্কা এসে রাজনীতির মাঠেও এসে পড়েছে। এখন সব কিছুই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। এখন বিরোধী পক্ষকে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের চেয়ে ষড়যন্ত্র করে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে কি করে ‘শর্টকাট’ রাস্তায় ক্ষমতায় যাওয়া যায় তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

দুই.

সাদেক হোসেন খোকা দিয়ে শুরু। তারপর দেশের মানুষ বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক নেতা থেকে রাজনৈতিক নেতাদের রক্তমাখা ছবি আগ্রহ ভরে প্রত্যক্ষ করেছে। সেই তালিকায় সর্বশেষ কুষ্টিয়ায় মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নাম যুক্ত হয়েছে। আদালত চত্বরে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে মাহমুদুর রহমানের গাড়ি ভেঙে তার ওপর হামলা করে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে। মাহমুদুর রহমানকে হামলার এ সংবাদটি যত দ্রুত সংবাদমাধ্যমে আসা উচিত তার চেয়েও দ্রুততার সাথে হামলার ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সরকারের উচ্চমহলের টনক নড়ে। ভিডিওটিতে হামলার পর হেঁটে হেঁটে আদালতের ভেতরে গিয়ে মাহমুদুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ধরে বিষোদ্গারপূর্ণ মন্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে দুই ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার তৈরি করে। তার বক্তব্যে একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় সন্দেহ আর সহানুভূতি। পাশাপাশি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন হামলার প্রায় সাথে সাথে পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি নিয়ে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর বিষয়টি তাদের মধ্যে নানাধরনের শঙ্কা ও প্রশ্নের তৈরি করেছে।

বিএনপি নেতৃবৃন্দ এ হামলার দায় নিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করার হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন দেশপ্রেমিক মাহমুদুর রহমানের ওপর এই ন্যক্কারজনক হামলা ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা ঘটিয়েছে। অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বিএনপির নেতাদের এ ধরনের বক্তব্যকে নিছক পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়ে হেফাজতের ৫ মে থেকে শুরু করে উত্তরা ষড়যন্ত্র, গণজাগরণ মঞ্চের সময় ‘আমার দেশ’ পত্রিকার বিতর্কিত ভূমিকা, সাম্প্রদায়িক বিনষ্টকারী হিসেবে মাহমুদুর রহমানকে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনকে বানচাল ও দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে বিএনপির কূটকৌশলের অন্যতম ‘থিংক ট্যাঙ্ক’ মাহমুদুর রহমানের পক্ষে এ ধরনের পরিকল্পিত হামলা ঘটানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা মাহমুদুর রহমানকে একজন ঠান্ডা মাথার চিহ্নিত রাজনৈতিক দাঙ্গাবাজ উল্লেখ করে বলেছেন, কুষ্টিয়ার এই হামলা দিয়ে মাহমুদুর রহমান কিসের পূর্বাভাষ দিলেন তা নিয়ে সরকার গভীরভাবে পর্যালোচনা করবে। এই হামলা দিয়ে কি পরবর্তীতে সংঘটিত অন্য হামলাকে বৈধতা দেয়া হবে কি না তা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন।

এদিকে মাহমুদুর রহমানের হামলার রক্তাক্ত ভিডিওটি অন্তর্জালের মাধ্যমে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির ঝিমিয়ে পড়া নেতারা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে স্তুতি করতে দেখা যায়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাকে নিয়ে স্তুতি ঝাড়তে গিয়ে দলের অন্যান্য বুদ্ধিজীবী তাত্ত্বিক নেতাদের তুলোধুনো করতেও ছাড়েননি। এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মওদুদ আহমদ বলেছেন, আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের সঙ্গে আরেক সম্পাদক শফিক রেহমান ও অধ্যাপক আসিফ নজরুলদের মতো কয়েকজন ‘বুদ্ধিজীবীই’ এখন সরব আছেন, বাকি সবাই ‘বিক্রি’ হয়ে গেছেন।

তিন. রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মাহমুদুর রহমানের হামলার বিষয়টিকে নানাভাবে মূল্যায়িত করেছেন। তারা বলছেন, আদালত প্রাঙ্গণে একজন নাগরিকের ওপরে এভাবে হামলা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। সরকারের উচিত হবে এ ঘটনার সঙ্গে যে বা যারা জড়িত তাদের ধরে এর প্রকৃত বিচার করা। তারা বলছেন, হামলার এ ঘটনাটিকে দুই পক্ষই যদি পরিকল্পিত বলে দোষারোপের ক্ষেত্রকে বড় করে তোলে তাহলে প্রকৃত হামলাকারী নিরাপদে থেকে পরবর্তী হামলার জন্য ওত পেতে থাকবে কি না তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারি দলের। এক্ষেত্রে সরকারি দলের ভূমিকা অনেক বেশি। এখন দেখার বিষয় সরকারি দল মাহমুদুর রহমানের এই হামলাকে সাজানো বলবেন, না পরিকল্পিত বলবেন নাকি সুদূরপ্রসারী কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ বলবেন?

মাহবুব রেজা: কথাসাহিত্যিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :