বরুণ রায়: এক সংগ্রামীর মুখ

তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ
 | প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:০১

মৃত্যু মানবজীবনের এক চিরন্তন সত্য হলেও কিছু কিছু মৃত্যুকে মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়। যদি সে মৃত্যুটি হয় অসময়ে, অস্বাভাবিক; আর ব্যক্তিটি যদি হন অনন্য-অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনক বরুণ রায়ের মৃত্যু তেমনই একটি। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পাড়ি জমান পরপারে।

অতি আপনজনের মৃত্যুর মতোই তার মৃত্যুর দুঃসংবাদটি আমাকে যারপরনাই ব্যথিত করেছিল। বরুণ রায়কে জেনেছি মুক্তিযুদ্ধের একজন মহান সংগঠক ও অতুলনীয় ব্যক্তি হিসেবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বরুণ রায় ছিলেন অতি উজ্জ্বল একটি নাম। সারা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের দাবি আদায় ও মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামে।

জমিদার পরিবারে জন্ম নেয়া বরুণ রায় আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের জীবন ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন মানুষের মনের গভীরে। মানুষের কল্যাণে নিবেদিত অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কিংবদন্তি পুরুষ হিসেবে পরিণত হয়েছিলেন।

সাদাসিধে ও সৎ জীবনযাপনের কারণে তিনি বরুণ রায় নামে এতই খ্যাতি ও পরিচিত ছিলেন যে, এই নামের আড়ালে তার আসল নামটি ‘প্রসূন কান্তি রায়’ ঢাকা পড়ে যায়। তিনি একই ভূখণ্ডে তিন-তিনটি ভিন্ন রাজত্বের শাসনামলে বসবাস করে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছিলেন। একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদের সচেতন সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে তিনি তিনটি কাল অবলোকন করে গেছেন। এই নক্ষত্রের সততা ও সংগ্রামী জীবনাদর্শের কথা নতুন প্রজন্মের তরুণ-যুবাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আশা করছি।

কমরেড বরুণ রায় এমনই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন যার জীবন ছিল সব ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।

বরুণ রায় জন্মগ্রহণ করেন এক ঐতিহ্যবাহী আলোকিত জমিদার পরিবারে। তার বাবা করুণা সিন্ধু রায় জমিদারি পরিচালনায় জড়িত না হয়ে প্রথম জীবনে নিজেকে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নিয়োজিত করে পরবর্তীকালে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি প্রজার ভূমির ওপর প্রজাস্বত্ব প্রতিষ্ঠার নেতা হিসেবে কৃষকদের মধ্যে অমর হয়ে আছেন।

বরুণ রায়ের জন্মস্থান পিতৃভূমি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী থেকে অনেক অনেক দূরে ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনায়। তার পিতামহ রায় বাহাদুর কৈলাস চন্দ্র রায়, বিহার রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন। সেই সুবাদে বরুণ রায়ের বাবা-মার বাস ছিল সেখানেই। তাদের পাটনায় বসবাসকালেই জন্ম বরুণ রায়ের।

তার বাবার কলেজজীবনের বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বোস। এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর সাহচর্যের প্রভাবে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নিজে জমিদার হয়েও জমিতে প্রজাস্বত্বের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করেন। আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি কৃষকদের নিয়ে আন্দোলন করে কৃষকদের প্রাণের দাবি প্রজাস্বত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বরুণ রায়ের পারিবারিক এমন অসংখ্য বর্ণাঢ্য বর্ণনা রয়েছে।

বরুণ রায় সিলেট এমসি কলেজে বিএ পড়ার সময় ১৯৪৮ সালে পরীক্ষার প্রাক্কালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জমিদার পরিবারের ঐতিহ্যিক আবহে জন্মগ্রহণ করলেও সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলতেই রাজনীতিতে সক্রিয় হন বরুণ রায়। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। মানবকল্যাণে কাজ করতে গিয়ে জেল খেটেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন।

পাকিস্তানি অন্ধকার যুগের এক নন্দিত বিপ্লবী জননেতা বরুণ রায়। মাতৃভূমি ও জনগণের কল্যাণে জীবন উজাড় করে তিনি আজীবন ত্যাগের রাজনীতি করেছেন। জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দিনগুলো হয় জেলে না হয় আত্মগোপনে কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধে তিনি অনন্য সাহসী সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে ও পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃসময়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও চেতনা ধরে রাখতে তিনি অকুতোভয় সৈনিকের মতোই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীনতার বেশ ক বছর পরের কথা। আমি তখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। স্কুল ছুটির পর আমাদের বাড়িতে হঠাৎ দেখি অনেক মানুষের ভিড়। আম্মা বলছিলেন, ‘বরুণ বাবু আইছইন। তোমরা এখন দূরে যাও। খাওয়া-দাওয়ার পরে আইসো।’

শত শত মানুষের ভিড় ঠেলে খুব কষ্টে গেলাম বরুণ বাবুর ¯স্নেহাশীষধন্য আমার কাকা শফিকুর রহমান চৌধুরীর কাছে। তিনি আমাকে কোলে তুলে বরুণ বাবুর কাছে নিয়ে পরিচয় দিলে তিনি আমার গালে ধরে আদর করেন। আমার বাবা মফিজুর রহামান চৌধুরীর সঙ্গে কী যেন গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছিলেন তখন। কিছুদিন পর দেখি বরুণ বাবুর ছবিসহ ‘তালা চাবি’ মার্কার পোস্টার এসেছে আমাদের ঘরে। আব্বা আর কাকা আমাকে ডেকে সারা গ্রামে বরুণ বাবুর পোস্টার লাগানোর দায়িত্ব দিলেন। আমি আমার সহপার্ঠীদের নিয়ে সারা গ্রামে বরুণ বাবুর পোস্টার লাগিয়েছিলাম।

আমার কাকা ছিলেন বরুণ রায়ের একজন খুব কাছের দলীয় কর্মী। শৈশবের এমন মধুর স্মৃতিতে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে পড়ছে সেই কিংবদন্তি নেতা বরুণ রায়কে। এই মহান সংগ্রামী জননেতা ১৯৮৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকা (জামালগঞ্জ, ধরমপাশা, তাহিরপুর) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদ সদস্য থাকাকালে ১৯৮৭ সালে তাকে কারাবণ করতে হয়। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের বজ্রকণ্ঠের কারণেই তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় জেল খেটেছেন।

স্বাধীনতার মাসে ৮ ডিসেম্বর ছিল তার সপ্তম প্রয়াণ দিবস। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও লাল সালাম।

লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, জামালগঞ্জ প্রেসক্লাব, সুনামগঞ্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :