মুক্তিযুদ্ধের ৫০ শহীদের সমাধিস্থল কোল্লা পাথর

মিশু, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়ীয়া)
  প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:০৮
অ- অ+

ফিরে এসেছে বাঙালি জাতির অহংকার ও গৌরবের মাস ডিসেম্বর। ঘুরে আসুন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের স্মৃতিজড়িত সীমান্তঘেঁষা কোল্লা পাথর সমাধিস্থল। এই সমাধিস্থলে দুইজন বীরউত্তম, একজন বীরবিক্রম ও দুই জন বীরপ্রতীকসহ মোট ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে।

এই সমাধিস্থলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি রেস্টহাউজ, আছে মসজিদ, হৃদয় আলোড়িত করবে সবুজ পাহাড়ের বৃক্ষ। প্রতিদিন অগণিত দর্শনার্থীদের পদভারে সরব থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের শহীদ স্মৃতিভূমি কোল্লা পাথর এলাকা।

আগত অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আবার অনেকে মুক্তিযুদ্ধ না দেখেও হৃদয়ে ধারণ করতে চান, সেই মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলো। অনুধাবন করতে চান মুক্তিযুদ্ধের রক্তাত মর্মার্থ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে কোল্লা পাথরে সারিবদ্ধভাবে নাম-ঠিকানা অনুসারে শহীদের কবর সাজানো হয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা খুব সহজেই মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বীরদের পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারছেন।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পুরো জাতির যেমন গৌরবের ও অহংকারের বিষয়, তেমনি বেদনারও কম নয়। আমরা হারিয়েছি ৩০ লাখ বাঙালি সন্তানকে। এই রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধকে জাতির সামনে তুলে ধরার মহান প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে চলছে মুক্তিযুদ্ধ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবা কোল্লা পাথর সমাধিস্থল।

১ ডিসেম্বর সরেজমিন ঘুরে এলাম। কথা হলো কোল্লা পাথর সমাধিস্থল দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের সঙ্গে। তিনি ঢাকাটাইমসকে জানান, ১৯৭১ সালের ৬ জুন থেকে ওই বছরের সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে যারা গেরিলাযুদ্ধ ও সম্মুখসমরে শহীদ হন- তাদের মধ্যে এই ৫০ জনের মরদেহ পরম শ্রদ্ধায় তার পরিবারের সদস্যরা এখানে সমাহিত করেন। ৫ ডিসেম্বর এ এলাকা হানাদার দখলমুক্ত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক কোল্লাপাথর শহীদের স্মৃতিজড়িত কবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেন। ১৯৮০ সালে সেখানে একটি কাঠের তৈরি রেস্টহাউজ হয়। গত এক দশকে কোল্লাপাথরে গড়ে উঠে স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, রেস্টহাউজ, সীমানা প্রাচীর ও পুকুরঘাট। প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা পরিষদ এই কাজ করে।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম আরো জানান, এটা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। স্মৃতিসৌধের জন্য তারা ৬৫ শতাংশ জায়গা দান করেন। ১৯৭২ সালে এই সম্পত্তির সম্পূর্ণটাই সরকারকে দান করেছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের পিতা আব্দুল মান্নান। তাদের পরিবার দেশকে উৎসর্গ করেছেন এই সম্পত্তি। একটি ছোট টিলার উপরে এই সমাধিস্থলটি।

তিনি আরও বলেন, কসবার এই এলাকাটি বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা- যা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কারণে এ অঞ্চলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে অন্যতম লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছিল। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ এলাকায় বেশি যুদ্ধ হয়েছে। বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এখানে একজন বীরবিক্রম, দু’জন বীরউত্তম, দু’জন বীরপ্রতীকসহ মোট ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। এখানকার প্রতিটি কবরের শিয়রে লেখা রয়েছে- মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম এবং তার আত্মীয়রা মিলে তাদের এই স্থানটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহ করে দাফন করেন।

আব্দুল করিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আঘাতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নিহত হলে এই টিলার ওপর সমাহিত করা হতো। লাশের সংখ্যা যখন ২৫-২৬টি হয়ে গেল, তখন তিনি নিজে ভারতের ত্রিপুরা থেকে টিনের প্লেটে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানা লিখিয়ে কবরের পাশে চিহ্নিত করে রেখেছেন। স্বাধীনতার পর এখানে শায়িত অনেকের নাম-ঠিকানা শনাক্ত করা হয়। তবে, আজও তিনজনের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তাদের কবরের সামনে অজ্ঞাত লেখা আছে।

আব্দুল করিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে দুই নম্বর সেক্টরটি ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশারফ। এই সেক্টরের মাধ্যমে মোট ২২৬টি অপারেশন হয়। কোল্লাপাথর সমাধিস্থল ছাড়াও আশেপাশে ১ হাজার ১৫৫জন শহীদের কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

কোল্লা পাথর সমাধিস্থলে চিরনিদ্রায় বীর সেনানীরা আছেন যারা- ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার কুড়িপাইকা গ্রামের নোয়াব আলী, আখাউড়ার নীলাখাদ গ্রামের মোরশেদ মিয়া, আখাউড়া তুলাই শিমুলের তাজুল ইসলাম, ধাতুর পহেলার শওকত মিয়া, আমির হোসেন, আখাউড়া মান্দাইলের সিপাহী আনোয়ার হোসেন, ঠাকুরগাও বালিয়াডাঙ্গী কালমেঘ গ্রামের সৈনিক দর্শন আলী, আর কে মিশন রোড (ঢাকা -৩)’র জাকির হোসেন (বীরপ্রতীক), কসবা জয়দেবপুরের আব্দুল জব্বার, সিলেট গহরপুরের হাবিলদার তৈয়ব আলী, বগুড়া সারিয়াকান্দির ল্যান্সনায়েক আব্দুস সাত্তার (বীর-বিক্রম), বিজরা লাকসামের সিপাহী আক্কাস আলী, কোল্লাপাথরের ফখরে আলম, কসবা কামালপুরের ফারুক আহম্মদ, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া নবীনগর কুড়িঘরের মোজাহীদ নূরু মিয়া, ময়মনসিংহের মহাদানের নায়েক মোজাম্মেল হক, নোয়াখালী মধ্যমকাচা গ্রামের নায়েক সুবেদার আব্দুস সালাম, ফরিদপুর পাঁচগাওয়ের সিপাহী মুসলিম মৃধা, শরিয়তপুরের নরিয়ার প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, কসবা মন্দভাগের আব্দুল অদুদ, কুমিল্লা মুরাদনগরের সিপাহী তমিজ উদ্দিন, হোমনার আবুল কাশেম, ব্রাক্ষণপাড়ার মোশারফ হোসেন, কুমিল্লা রামপুরের নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন (বীর-উত্তম), চাঁদপুরের মতলবের সিপাহী নূরুল হক, কসবা বড় বায়েক গ্রামের আব্দুল কাইয়ুম, কুমিল্লার সিপাহী হুমায়ুন কবীর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া নবীনগরের ল্যান্সনায়েক আব্দুল খালেক, বগুড়ার ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, ব্রাক্ষণপাড়ার মো. তারু মিয়া, চট্টগ্রাম সন্দ্বীপের বেলায়েত হোসেন (বীর-উত্তম), কসবার বাউরখন্দ গ্রামের রফিকুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ ভৈরবের আশুরঞ্জন দে, কসবা নিয়ামতপুরের আব্দুস সালাম সরকার, চাঁদপুর হাজীগঞ্জের জাহাঙ্গীর আলম, কসব সৈয়দাবাদ গ্রামের পরেশচন্দ্র মল্লিক, কুমিল্লা হোমনার জামাল উদ্দিন, কসবা শিকারপুরের আব্দুল আওয়াল, মাইখার আবেদ আহম্মদ, কুমিল্লা দেবিদ্বার ফতেয়াবাদ গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, হোমনা দৌলতপুরের ফরিদ মিয়া, ব্রাক্ষণবাড়িয়া বাঞ্ছারামপুরের মতিউর রহমান, বুড়িচংয়ের রাজাপুর গ্রামের সাকিল মিয়া, চাঁদপুর রহাইমচরের বিজয়পট্টির আনসার এলাহী বক্স পাটোয়ারি (বীর প্রতীক), বাঞ্ছারামপুর আব্দুর রশিদ, কসবার মজলিশপুরের সিপাহী শহিদুল হক, কুমিল্লা দেবিদ্বারের উজানীচর গ্রামের সিপাহী আব্দুল বারী খন্দকার এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও তিনজন।

ওই সমাধিস্থলে রয়েছে নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলামের কবর। তার নামেই ঢাকা সেনানিবাস এলাকার অতি পরিচিত মইনুল সড়ক নামকরণ করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম বলেন, কোল্লা পাথরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থলে সরকারি বা রাজনৈতিক দলের কোন কর্মসূচি না থাকলেও স্থানীয়রা তাদের শ্রদ্ধা জানাতে ভুলেন না। মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে শহীদদের আত্মীয়-স্বজনদের আগমন ঘটে এখানে।

প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে কোল্লা পাথর স্মৃতিসৌধ এলাকাকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে তোলা হয়।

(ঢাকাটাইমস/১৪ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/এলএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জনগণের প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক সুশাসন বিলম্ব হলে দেশ পিছিয়ে যাবে: লিটন 
নির্বাচন বিলম্বিত করতে প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে সরকার: যুবদল
মিটফোর্ডের ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ইতিহাসে প্রথমবার ক্রিকেট বিশ্বকাপে ইতালি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা