করোনা চিকিৎসায় দ্রুততম সাফল্যের গল্প

মাহবুব হাসান
| আপডেট : ০১ জুন ২০২০, ১৩:০৫ | প্রকাশিত : ০১ জুন ২০২০, ১২:৩৯

গত ১২ মে আমাদের একজন ক্লায়েন্ট বার বার ফোন করছেন, ইফতার শেষ করে ফোন ব্যাক করলাম। খুব উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা নিয়ে জানালেন- তার ড্রাইভারের করোনা পজিটিভ, আজ বেশ জ্বর ও গলা ব্যথা, কোন পরিচিত ডাক্তার থাকলে যেন দয়াকরে এখনই একটু সাহায্য করি। ড্রাইভারের করোনা পজিটিভ জেনে আমাদের ক্লায়েন্টের পুরো পরিবারই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কারণ যেদিন ড্রাইভার করোনা পরীক্ষা করিয়েছে সেদিনও সে তার মালিকের বাসায় বাজার করে দিয়ে গেছে। তাই ড্রাইভারের করোনা মালিকের বড় দুশ্চিন্তার কারণ। আমি অভয় দিলাম এবং যে কোনো বিপদে পাশে থাকার অঙ্গীকার করলাম। আমার কথায় তিনি কিছুটা নির্ভার হলেন, বেশ স্বস্তিও পেলেন।

ড্রাইভারও আমাকে চেনে। তাই মালিকের রেফারেন্সে একটু পরেই ফোন করল। মনে হলো ড্রাইভারের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। করোনা পজিটিভ জেনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। স্যার.. স্যার বলে নিজের পরিস্থিতি বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার কথার টোনে করোনা পজিটিভের বিষয়টিকে আমি খুব স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে নিয়েছি সেটা বুঝিয়ে দিলাম, আর বললাম ‘ধুর বেটা এটা কোনো রোগই না, টেনশনের কিছুই নাই, এখনই ওষুধ দিচ্ছি, কয়েকদিনেই ভালো হয়ে যাবা!’ মনে হলো ড্রাইভার আমার কথা শুনে প্রাণ ফিরে পেল! মোবাইলে ভেসে আসা আঠালো কন্ঠ শুনে মনে হলো তার চোখের কোণে জলও এসে থাকতে পারে।

ফোন রেখে নিজের আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’ এর পেলিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের মেডিকেল অফিসার আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ডাক্তার মেহেদী হাসান ভাইয়ের দেওয়া এই ওষুধগুলো (সংযুক্ত) সেবনের পরামর্শ দিলাম। আর ডাক্তারকে জাস্ট জানানোর জন্য বললাম - যে মেহেদী ভাই আমার পরিচিত এক রোগীর এই এই লক্ষণ ছিলো আপনার আগের দেওয়া ওই পরামর্শটি পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু। আপনাকে আর বিরক্ত না করে শুধু ওষুধের তালিকাটি আপানাকে টেক্সট করেছি। কোনো কারেকশন থাকলে দয়াকরে একটু জানান প্লিজ। আমার কথা শুনে তিনি একটু হাসলেন। বললেন- আপনিতো বেশ ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন ভাই। ওষুধ একদম সঠিক আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- আরেকটি ওষুধও ছিলো ওটা দেননি কেনো? বললাম - কাশি নেই তাই ওটা কেটে দিয়েছি.. কাশি হলে Doxiva 400mg দুইবেলা খেতে বলব। তিনি আবারো হাসলেন, বললেন- ওকে। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাইয়েন।

ওষুধগুলোর পরামর্শ দিলাম, তবে কেনো যেন মনে হলো যে প্রয়োজন ও অপ্রতুলতা মানুষের পছন্দকে এভাবেই হার মানায়। এতো বড় রোগ, অথচ বড় কোনো ডাক্তারের নাগাল পাওয়া যায় না। কয়েকদিন আগে আমার দুধের মেয়ে শিশুর টনসিলের জন্য ভালো ডাক্তারের অভাবে এক আনাড়ি ডাক্তারকে দেখাতে বাধ্য হলাম। ড্রাইভারকে আমি নিজেই বেশ কয়েকবার ফোন করে খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম, তার ফিডব্যাকে বুঝতেছিলাম ওষুধগুলো কাজ করছে।

গত ২২ মে একটি দারুণ ঘটনা ঘটলো। তারাবির নামাজ পড়ে ঘুমঘুম ভাব। সাইলেন্ট মুডে থাকা ফোনে ভুম ভুম করে বাজে এক প্রকার আওয়াজ হচ্ছে। রোজা শেষে কাঁচা ঘুম ভাঙানো ফোনের এমন বাজে আওয়াজে বউ বাইন মাছের মতো হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। সারাদিন তার অনেক ধকল গেছে। চোখ মেলে দেখলাম, সে মহাঘুমের ভানের আছে। ভাবলাম বাইরে বইয়ে যাওয়া ঝড়ের রেশ মশারির ভেতরে ঢুকাব না। বাম দিকে মোচড় দেওয়া বৌয়ের ডান হাত যেখানে শেষ হয়েছে ফোনটি তার থেকে সামান্য একটু দূরে। তাকে ঘুমন্ত ধরে নিয়েই ফোনটি কাছে আনলাম।

কিন্তু ফোনে কলারের নাম দেখে খুব মেজাজ খারাপ না হলেও সামান্য বিরক্তই লাগল। ফোন রিসিভ করলাম। কিন্তু ওপাশের আওয়াজ ছিল অন্য রকম। যা ঘুমের সকল অলসতাকে নিমিষেই উড়িয়ে নিয়ে গেলো। স্যার.. স্যার..। তার কন্ঠে কোনো কথাই বের হচ্ছিল না। পুরোপুরি গত ১২ মে’র বিপরীত ঘটনা। সেদিন করোনা পজিটিভের কষ্টে কথা বলতে পারছিল না, আজ করোনা নেগেটিভের আনন্দে কথা বলতে পারছে না। সবাই জীবনভর পজিটিভ কিছুর জন্য কতো কিছু করে আর শুধু রোগবালাই ও বিপদ আপদের বেলায় নেগেটিভ রিপোর্টের জন্য কেমন পাগল হয়ে যায়!

পরিস্থিতি নিজের কন্ট্রোলে নিতে একটু জোর গলায় বললাম- ‘আরে বেটা কী হয়েছে খুলে বলবে তো’। সে এবার ক্ষণিকের জন্য শান্ত হলো, কিন্তু খুশির জোয়ার আটকাতে ব্যর্থ হয়ে উচ্ছ্বোসিত কন্ঠে এক নিশ্বাসে জানালো, স্যার.. স্যার.. আপনি যা যা বলেছিলেন আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম। আজ আবার নতুন রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে স্যার..।

এরপর ড্রাইভার সাহেব আর যা যা বলল তাতে আমি কিছুটা আবেগ আপ্লুত না হয়ে পারলাম না। মানুষ সামান্য আনন্দের জন্যও কত কিছু শেয়ার করে, আর আমি একজন ডাক্তারের একটি পরামর্শ শেয়ার করে এত আনন্দ কুড়ালাম। যাইহোক, আর ঘুমোতে পারলাম না, সেহরি শেষেও আর ঘুম এলোনা। ভাবলাম- করোনা ভয় ওর মনে তাহলে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল? ও কি তাহলে ধরেই নিয়েছিল যে ওর গাড়ির গতি এখানেই শেষ হতে চলেছে? সেজন্যই কি তাহলে ও এত দ্রুত ফিরে এলো! বাংলাদেশের সব মানুষগুলো তাহলে এই ড্রাইভারের মতো জীবনের মায়া করছে না কেন? তাহলেতো এরা সবাই দ্রুতগতিতে জীবনে ফিরে আসতো!

১১ ও ১৬ বছরের দুইটি ছেলে এবং স্ত্রীসহ ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে ড্রাইভার দুই রুমের একটি ভাড়া বাসায় থাকে। পরিবারের অন্য কারো এখনো কোন সমস্যা হয়নি। সে এতো ছোট একটি বাসায় থাকা সত্ত্বেও পরিবারের সাথে কঠোরভাবে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। ডাক্তার মেহেদী ভাইকে তার নেগেটিভ রিপোর্টের সুসংবাদটি দিলাম, তিনি বললেন- এই সাফল্যের কারণ রোগী নিজেই, কারণ তিনি আপানার পাঠানো পরামর্শগুলো শতভাগ মেনে চলেছে। তাই এতো দ্রুত রিকোভারি করা সম্ভব হয়েছে। রোগীর কো-অপারেশন ছাড়া কোনো রোগই ডাক্তার ভালো করতে পারে না।

পুরো ঘটনাটি আমাদের ক্লায়েন্টকে দারুণভাবে স্বস্তি দিয়েছে, একটি বড় খুশির কারণও হয়েছে বটে। আর করোনা দূর্যোগে ওই ড্রাইভার সাহেবের করোনামুক্ত হবার উচ্ছ্বাস আমাকে কী পরিমাণ খুশির যোগান দিয়েছে তা বলে বুঝাতে পারব না, তাই সকলের জন্য কিছুটা লিখে শেয়ার করলাম।

[বি:দ্র: দয়াকরে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কেউ এই অভিজ্ঞতাকে নিজের ওপর বা পরিবারের কারো উপর বা কোন পরিচিতজনের ওপর ভুলেও প্রয়োগ করবেন না।]

লেখক: ব্যাংকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :