রেললাইনে ঝুঁকিপূর্ণ বাজার, প্রভাবশালীদের ‘চাঁদাবাজি’

ইফতেখার রায়হান, গাজীপুর
 | প্রকাশিত : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৫০

গাজীপুরের টঙ্গীর বৌ-বাজার এলাকায় রেললাইন দখল করে গড়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ বাজার ও স্থায়ী মার্কেট। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি এই রেলপথ ব্যবহার করে শতাধিক ট্রেন চলাচল করে এবং এই রেলক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের যাতায়ত। লেভেল ক্রসিং না থাকায় প্রায়ই এ রেলপথে পথচারী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যেই রেললাইনের দুইপাশ ও মাঝখানের অংশটি দখল করে গড়ে উঠেছে বাজার।

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠা এই বাজারের স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানগুলো থেকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলণ করছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। বছরে এই চাঁদার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকায়। এই টাকার একটি অংশ যাচ্ছে রেলওয়ে পুলিশের অসাধু কয়েকজন কর্মকর্তার পকেটে। শুধু বাজার নয়, রেলওয়ের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বস্তি, রিকশার গ্যারেজ ও স্থায়ী মার্কেট। কিছু কিছু জায়গায় টিনের ঘের দিয়ে স্থাপণা নির্মাণ করে দখল পাকাপোক্ত করেছে দখলকারীরা। দোকান ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালী মহলটি। টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের আওতাধীন বৌ-বাজার এলাকায় রেললাইনের মাঝখানে এবং দুইপাশে গড়ে উঠা ছোট-বড় প্রায় পাঁচ শতাধিক দোকানের ভাড়া হিসেবে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে অগ্রিম বাবদ দিতে হয় সর্বন্মি ৩০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা। প্রতিদিন এসব দোকান ও বিট থেকে ১০০-২০০ টাকা উত্তোলণ করা হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ বিল বাবদ লাইট প্রতি নেওয়া হয় দৈনিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

সূত্র জানায়, বৌ-বাজার এলাকার রেলের জায়গাগুলো থেকে প্রতিদিন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে চাঁদা উত্তোলণ করা হয়। তারা হলেন- ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য সচিব গাজী সালাহউদ্দিন, যুগ্ম আহ্বায়ক কবির বেপারি, শহিদ গাজী, বিএনপি নেতা সুমন সরকার, আরফান ওরফে ফেন্সি আরফান, পালসার বাপ্পি, জিএম শামীম ওরফে ভাইস্তা শামীম, আরিফ, শাহাবউদ্দিন, মোমেন সরকার, হাবিবুর রহমান, আব্বাস উদ্দিন, শামসুউদ্দিন, মোশারফ, জুলহাস খান, বিএনপি নেতা কাউসার ও রাশেদুল।

অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে গড়ে উঠা এসব দোকান ও স্থাপনা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন প্রভাবশালী মহলটি। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত আছে, যার যার মার্কেট ও বাড়ির সামনের রেলের খাস জমি থেকে উত্তোলিত চাঁদা তারা নিজেরা নেবেন।

বৌ-বাজার এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানদাররার জানান, রেললাইনের পূর্ব-দক্ষিনপাশ ঘেষে সরকার বাড়ি রোডে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫০টি দোকান ও গোডাউন। সিরিয়ালের প্রথম ১০টি দোকান থেকে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০টাকা করে বিএনপি নেতা সুমন সরকারের নেতৃত্বে চাঁদা উঠানো হয়।

অভিযোগ রয়েছে, সুমন সরকারের মালিকানাধীন মরিয়ম সরকার মার্কেটের সামনের একটি বড় অংশ রেলের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে। সরকার বাড়ি রোডের বাকি দোকান ও গোডাউনগুলো থেকে চাঁদা উঠায় আওয়ামী লীগ নেতা কবির ব্যাপারী, আরফান ওরফে ফেন্সি আরফান ও পালসার বাপ্পি। পূর্ব উত্তরপাশের প্রায় ১০টি দোকান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী সালাউদ্দিনের নামে চাঁদা উঠানো হয়। তিনিও রেলের কিছু অংশ দখল করে তিন তলা মার্কেট নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দুই রেললাইনের মাঝখানের প্রায় ৫০টি কাঁচাবাজারের দোকান থেকে টাকা আদায় করেন, আওয়ামী লীগ নেতা কবির বেপারী, গাজী সালাউদ্দিন, শহিদ গাজী। এসব চাঁদার টাকা উত্তোলণ করেন লাইনম্যান রাশেদুল। রেললাইনের দক্ষিন-পশ্চিমপাশের পাঁচটি রিকশার গ্যারেজ থেকে মাসিক এবং অর্ধশতাধিক দোকান থেকে দৈনিক ১০০-১৫০ টাকা করে সাবেক ছাত্রদল নেতা জিএম শামীম ওরফে ভাইস্তা শামীম, আরিফ, আকরাম, মোমেন সরকার ও শাহাবউদ্দিনের নামে চাঁদা উঠানো হয়। রেললাইনের উত্তর পশ্চিম পাশের প্রায় শতাধিক কাঁচাবাজার দোকানির কাছ থেকে দৈনিক ১০০ টাকা চাঁদা উঠানো হয় হাবিবুর রহমান, আব্বাস ও শামসুদ্দিনের নামে। ভাঙ্গারি পট্টি থেকে চাঁদা উঠায় মোশারফ। এসব দোকানদারদের থানা পুলিশের কোনো ঝামেলা হলে সেসব সমাধান করেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি বিএনপি নেতা কাউসার। এদিকে গরু হাট এলাকায় জাকিরের নেতৃত্বে রেলের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে বস্তি। অন্যদিকে মধুমিতা রেললাইনের পশ্চিম পাশে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত ২০টি দোকান, গোডাউন ও বালুমহাল। এসব দোকান থেকে স্থানীয় বাড়িওয়ালা মালিক সমিতির নামে টাকা উঠানো হয় বলে জানায় স্থানীয়রা।

এছাড়াও রেলজংশনের প্রবেশ মুখে রেলের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে চোরাই জুতার বাজার। টঙ্গী ও আশপাশের এলাকার মসজিদ, অফিস ও বাসা-বাড়ি থেকে জুতা চুরি করে এনে এই বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে রেলওয়ে পুলিশ এ চোরাই জুতার বাজারটি উচ্ছেদে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

বনমালা এলাকায় রেললাইনের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ২০টি দোকান। এসব দোকান থেকে টাকা উঠায় ভান্ডারির ছেলে আমিনুল ইসলামসহ কয়েকজন। এসব অবৈধ স্থাপনা ও দোকান থেকে এককালীন টাকা জামানত বাবদ নেওয়া হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা তাহমিনা বেগম বলেন, 'কয়েক হাজার অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে রেলের জায়গা দখল করে। এগুলো উচ্ছেদ করে রেল চলাচল নিরাপদ করা হোক।’

দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত রেলের এসব জায়গা অবৈধ দখলে রেখে ব্যবসা করছে দখলদাররা। ফলে সরকারও বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। অথচ এসব বন্ধে কর্তৃপক্ষের নেই কোন নজরদারি।

তবে রেলকর্তৃপক্ষ বলছে, তবে স্থানীয় এবং দলীয় প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় দোকান ঘর উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দখলদাররা বলছেন, কর্তৃপক্ষ চাইলে সরে যাবেন তারা।

এদিকে আওয়ামী লীগ নেতা কবির ব্যাপারি বলেন, ‘আমার নামে চাঁদা উঠানোর বিষয়টি সঠিক নয়। এখানে দলীয় কিছু ছেলেরা টাকা উঠায়।’

আওয়ামী লীগ নেতা গাজী সালাহ উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘টেলিফোনে কিছু বলা যাবে না।’ সামনে এলে কথা হবে বলে তিনি সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।

হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন গাড়ি ড্রাইভ করতেছি। আপনি আগামীকাল সকালে দেখা করেন।’

এছাড়াও আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, ‘এই জমি আগে আমাদেরই ছিল। রেল অধিগ্রহণ করে নেয়ার পর জায়গা খালি পড়ে থাকায় আমরা দোকান নির্মাণ করেছি। এছাড়া রাতের পাহারা বাবদ কিছু টাকা উঠানো হয়।’

(ঢাকাটাইমস/১৩ফেব্রুয়ারি/পিএল)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :