মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভাবদর্শন

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
  প্রকাশিত : ২৫ মার্চ ২০২১, ২৩:০৫
অ- অ+

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের যুদ্ধ, শোষণ-বঞ্চনার শিকল ছেঁড়ার ৯ মাসের যুদ্ধজীবনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল হাজার বছরে গড়ে ওঠা বাঙালির সংস্কৃতিসঞ্জাত এবং একই ভিত্তির ওপরে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট দেশপ্রেমমূলক কালজয়ী কিছু গান। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে সংগীতের ভূমিকা এক অসামান্য ও উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। একটি জাতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তার অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক কালপর্বের প্রভাবও তাকে নানামুখী গতি দেয়। সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিÑ এ তিনের সংমিশ্রণে জাতীয় জীবনের গতিপথ প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বঞ্চনার প্রশ্নটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তার সাংস্কৃতিক বঞ্চনার প্রেক্ষাপটও এই বিশ্লেষণের আওতায় বিবেচিত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনের ভিত্তি গ্রথিত হয়েছিল ১৯৭১-এর বহু আগে। কিন্তু আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার কার্যকর ও বাস্তব সংগ্রাম ১৯৭১-এ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ফলে ১৯৭১ শুধুই প্রস্ফুটনের এক উপযুক্তকাল বললে অত্যুক্তি হয় না। মুক্তিযুদ্ধের গান বলতে আমরা যে গানগুলো চিহ্নিত করছি তার কোনো কোনোটির রচনাকাল মুক্তিযুদ্ধের বহুকাল আগে।

বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত স্বপ্নের স্ফূরণ ছড়িয়েছে মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের সংগীত। মানুষ তার মনের আকুতি জানাতে একটু স্বস্তির পরশ নিতে গান শুনতে ভালোবাসে, তেমনি এ গান পরিস্থিতি বিচারে তার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করে। বিশেষ করে ভাটিয়ালির সুর যেমন মাঝিকে, মরমী গানের সুর যেমন বাউলকে অনুপ্রাণিত করে তেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন দেশ, মাটি ও বিজয়ের গানে। আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই মুক্তিযুদ্ধে তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল দেশাত্মবোধ জাগানিয়া সংগীতগুলো। এগুলোর টানে মানুষ একাত্ম হয়েছিল, জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল ঐশ^রিক শুভেচ্ছাদূত বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশ, মা, মাটি ও মানুষের জন্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার এ লড়াই অতটা সহজ ছিল না, কিন্তু এর জীবনধর্মিতা খুব সহজেই লড়াইটাকে একান্ত আমাদের করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভাবদর্শনেই নিহিত ছিল যুদ্ধজয়ের অনুপ্রেরণা। এসব সংগীত আমাদের হৃদয়ে এমন অনুরণন তৈরি করেছিল যেখানে শত্রুর যুদ্ধের হাতিয়ার তুচ্ছ বলে গণ্য হয়েছিল। তাই শক্তিশালী পাক হানাদার ও তাদের সহায়তাকারী ঘাতক দালালদের ষড়যন্ত্র মুক্তিকামী মানুষের উদ্দীপনার সামনে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

প্রাচীনকাল থেকে এদেশের সংগীত ঐকিক ধারাকে অবলম্বন করে চলছে, যাকে বলা হয় মেলোডিপ্রধান (একরৈখিক)। তাছাড়া মার্গ ও দেশিÑ এই উভয় পদ্ধতি গ্রামসভ্যতা থেকে উৎসারিত। মার্গসংগীত সুরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, আর দেশি সংগীত কথা ও সুরকে সমান প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলা সংগীত মাত্রই এই দেশি সংগীতের আদর্শে পরিচালিত, লোকসংগীতও এর ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্রনাথও লোকসংগীত বলতে দেশি সংগীতই বুঝিয়েছেন। শ্রী শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ গ্রন্থে ঋড়ষশ গঁংরপ- এর প্রতিশব্দরূপে ‘দেশি সংগীতকে’ যথোপযুক্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আধুনিক সংগীত বিকাশ লাভ করেছে উনিশ শতকে এবং বর্তমানকালে এক বিশিষ্ট আসন করে নিয়েছে। ফলে গ্রামসভ্যতাজাত সংগীতকে ‘লোকসংগীত’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু এই আধুনিক যুগের সৃষ্ট সংগীত ও প্রাচীন ধারাশ্রয়ী গ্রামজাত সংগীতের মধ্যে মৌলিক কোনো পরিবর্তন বয়ে আনেনি। আধুনিক সংগীত এবং লোকসংগীত উভয় ধারাই ঐকিকধারাকে (মেলোডি) অবলম্বন করে বর্তমান অবধি প্রবহমান। সেজন্য ইউরোপীয় সংগীত ধারায় ঋড়ষশ গঁংরপ যেভাবে যুক্তিযুক্ত, বাংলা সংগীতে তা প্রযোজ্য নয়। বরঞ্চ, দেশি সংগীতই যথোপযুক্ত।

বর্তমান আলোচনায় ‘লোকসংগীত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেহেতু এটিই বিশেষভাবে প্রচলিত ও প্রচারিত হয়েছে বলে অন্য অর্থে নয়। দেশি সংগীতেরই সমার্থক হিসেবে লোকসংগীতকে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য, অনেকে ঋড়ষশ গঁংরপ-এর অনুবাদরূপে লোকগীতি, পল্লীগীতি এবং লোকসংগীত ব্যবহার করেন। লোকসংগীতকে যদিও অনেকটা এর সমার্থকরূপে গ্রহণ করা যায়, কিন্তু লোকগীতি বা পল্লীগীতি তা নয়। ঋড়ষশ ঝড়হম-এর অনুবাদ হিসেবে লোকগীতি বলা যায়। আর পল্লীগীতির জন্ম আধুনিক নগরজাত সভ্যতার কোলে। অনেকটা আধুনিক গানের মতো আধুনিক লোকগীতি বা পল্লীগীতি হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা যায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বিভিন্ন গবেষণা হলেও এর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের পদক্ষেপ তেমন গভীরভাবে দেখা যায় না, বিশেষত সংগীতের ভূমিকা বিশ্লেষণী গবেষণা নেহাতই কম। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার চিত্র পরিস্ফুটিত হলেও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টি জনমনে যে গভীর ছাপ নিয়ে বিদ্যমান ও উদ্দীপনা জাগ্রতকরণে সংগীতের ভূমিকা বিশ্লেষণ অতি জরুরি। আলোচ্য প্রবন্ধটি মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের একটি বিশেষ দিক হিসেবে সংগীতের প্রভাবের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে; যে দিকটি এতদিন প্রায় উপেক্ষিতই রয়েছে বলা চলে। ক্ষেত্র গবেষাণার ফলে প্রবন্ধটি মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক উপাদানের বিশেষ করে সংগীতের ভূমিকা বিষয়ক গুরুত্ব অনুধাবন করা সহজ হবে।

বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ একটি জাতি। বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের উন্নত সাহিত্যের গৌরবময় ধারাবাহিকতা। এটি অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার যে, নৃতাত্ত্বিকভাবে সমগোত্রীয় একটি জাতি একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় নিজ ঐতিহ্যের ধারা নিয়ে গৌরবের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল বসবাস করে আসলেও তার নিজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা বিশেষত ‘জাতিরাষ্ট্র (ঘধঃরড়হ ঝঃধঃব)’ গঠনে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার বছর। কিন্তু এ কারণে বাঙালির চেতনা বিদ্যমান ছিল না একথা বলার সুযোগ নেই। জাতি চেতনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও জাতিরাষ্ট্র কেন সৃষ্টি হয়নি সেটি হয়ত ভিন্ন গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমরা এই গবেষণায় দেখব যে, বাঙালির জাতি চেতনা বর্তমান বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে কতটা গভীরভাবে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই ‘জাতি চেতনা’র বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হবে বাঙালি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার আলোকে যা সে সুদীর্ঘকাল ধরে সযত্নে লালন করে এসেছে। মূলধারার নানান রাজনৈতিক কালপর্বে সামাজিক জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও বাঙালির জাতিসত্তার বিলোপ কখনই হয়নি বরং বহতা নদীর সজীবতা নিয়ে সে বর্তমানে পৌঁছেছে। বাঙালি জাতির এই সজীব সাংস্কৃতিক চেতনাই তার ‘জাতীয়তাবোধ’-এর শক্ত ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল, যা উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং দুইয়ের সম্মিলনে এক অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বার আন্দোলন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়।

আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দর্শন খুঁজতে যাই তখন অবিসংবাদিতভাবে একথা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক দর্শন। একইভাবে আরেকটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এ যুক্তিও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি হলো তার সুদীর্ঘকালের ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক ধারা ও ঐক্য। এ কারণেই আমরা যুক্তি দিতে চাই যে ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক, যতটা অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত, ঠিক ততটাই সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমগোত্রীয় বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করতে হয়েছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর রাজনৈতিক উপেক্ষা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা যখন চরমে পৌঁছে তখনই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টিও সমভাবে প্রতিভাত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে সম্ভবত জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে বাঙালিকে এমনভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলার মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং রাজনৈতিক পরিবেশ যাই থাকুক না কেন বাঙালির সাংস্কৃতিক ধারা তার আপন গতিতেই প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন ইসলামীকরণ নামে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর একটি আঘাত হানে অর্থাৎ পাকিস্তানের ঝঃধঃব উরংপড়ঁৎংব যখন বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি একটি অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয় তখনই বোঝা যায় বাঙালি জাতিসত্তার প্রাণভ্রমরা আসলে তার সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যÑ যার ওপর আঘাত বাঙালি জাতি সহ্য করতে পারেনি আর এ কারণেই রাতারাতি দ্বিজাতি তত্ত্বের দর্শন ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়।

একটি জাতি হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় বাংলার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক ধারা তেমনিভাবে একটি ‘বাঙালি আত্মা/মন’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই ঋদ্ধ ও পূর্ণ বিকশিত ‘আত্মা’ যখন অস্তিত্বের সংকটে নিপতিত হয় তখনই তা হয়ে ওঠে বিপ্লবী এবং প্রতিবাদী, এ কারণেই আমরা দেখি যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন গানগুলো ধর্ম বা অন্য কিছু নয় বরং ‘বাঙালি’ শব্দটিকেই তার চেতনা ও প্রেরণার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে, ‘বাংলা’ বা ‘বাঙালি’ শব্দটিই প্রেরণার কেন্দ্র।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুধীজনেরা লোকসংগীতকে সামগ্রিক সৃষ্টি বলে মনে করে থাকেন। তবে বাংলার লোকসংগীত শুধু সমষ্টির সৃষ্টি নয়, অনেকাংশে ব্যষ্টিক রচনা হিসেবেও পরিগণিত হওয়ার দাবি রাখে। এর দৃষ্টান্ত প্রাচীন চর্যাপদের গীতিকা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের অসংখ্য রীতি দিয়ে বোঝানো সম্ভব। যেমন- বাউল, মরমিয়া, দেহতত্ত্ব গানের রচয়িতার নাম-ভণিতায় এর সাক্ষ্য মেলে। উৎসভূমি সমাজ-সংস্কৃতি আর প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পরিণত হয়েছে এই ধারা। বলতে গেলে এই দৃষ্টান্তই ঢেউ তুলেছে বাংলা লোকসংগীতে। বাউল গান যেমন একক সৃষ্টি হলেও তৎকালীন সমাজের শুধু নয়, সর্বকালীন মানবহৃদয়ের চিরন্তন আকুতি প্রকাশ পায় জগৎ ও জীবন সম্পর্কে; তার প্রকাশ সমগ্র মানবসমাজের সৃষ্টিরূপে গণ্য হতে পারে। প্রথমে ব্যক্তি এবং পরে তা মুখে মুখে সুরে সুরে প্রচারিত হয়ে সমষ্টিচেতনায় উত্তীর্ণ হয়। ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়ার পথেই সমাজ এসেছে এবং সমাজ ব্যক্তিকেই অনুবর্তন করেছে। যেমন- ভাটিয়ালি গান। ব্যক্তি চেতনার গান- পুরোপুরি একক কণ্ঠের গান। ক্রমে তা লোকমুখে প্রচারিত হয়ে সমাজ মানসে উত্তীর্ণ হয়। সুতরাং বাংলাদেশে সেই সংস্কৃতির সূচনালগ্ন থেকেই মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকসংগীত বেশ জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। বিশেষ করে ভাটিয়ালি, জারি-সারি, ভাওয়াইয়া এবং অন্যান্য বাউল গানের কথা বলা যেতে পারে। যেমন, পল্লীগীতি বা গ্রামীণ সংগীত সব সময়ই গ্রাম-বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভাওয়াইয়া ও পল্লীগীতির অন্যতম পুরোধা ছিলেন আব্বাস উদ্দীন আহমেদ।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এদেশের সংগীতের বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁর গানের মধ্যে রয়েছে: ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী সংগীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, জারি-সারি, গজল, কাওয়ালি, ভৈরবী, কীর্তন ও শ্যামাসংগীত। নজরুল বহু ইসলামি গানও রচনা করেন। আব্বাস উদ্দীন ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে সংগীতের গুরু হিসেবে বিশেষ সম্মানের অধিকারী। বিশেষত এসব সংগীতের মধ্য দিয়ে তাঁরা মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করেন যার ধারাবাহিকতা মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত সংগীতগুলোতেও ছিল। তাঁদের সংগীত এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সংগীত বিনোদনমূলক সমাবেশের অন্যতম উপাদান হিসেবে উপভোগ্য হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময় তা উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ভাটিয়ালি, সারি, ভাওয়াইয়া খুবই সুশ্রাব্য এবং জনপ্রিয় সংগীত। এর সঙ্গে পাকিস্তানবিরোধী চেতনা যুক্ত হওয়ায় খুব সহজে তা মানুষের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এ শ্রেণির গানের আবেদন জোরালো ও উদ্দীপক হওয়ায় তা যুদ্ধক্ষেত্রে সংগীতের শক্তিমত্তার অসীমতাকেই প্রকাশ করেছে।

যেখানে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি বিপরীতধর্মী, কিংবা শত্রুশক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে, সেখানেও সংগীতের শক্তি চূড়ান্ত সত্যের পক্ষে, মানবতার পক্ষে সমবেদনা ও সহমর্মিতা দেখাতে সক্ষম হয়। জর্জ হ্যারিসন বা পণ্ডিত রবিশংকর কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে খোদ আমেরিকায় কনসার্ট করে শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বিশ^বাসীর দরবারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান তুলে ধরার প্রচেষ্টা সংগীতের বিশ^-শক্তিমত্তার এক অনন্য স্বাক্ষর। যুদ্ধ যখন অনিবার্যভাবে কোনো জাতির মুক্তির একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়, তার অস্তিত্বের সংগ্রাম ও আত্মপরিচয় বিনির্মাণের অবিকল্প পটভূমিÑ আর সেই জাতি যদি হয় মেধা-মননে হৃষ্ট, ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের দীর্ঘ ইতিহাসের গৌরবান্বিত, তাহলে তার বাসনা পূরণের মাধ্যম হিসেবে সংগীত কেবল প্রেরণার উৎস হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে অস্ত্রের সমকক্ষ, কখনো বা তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। কেননা একটি বুলেট মাত্র একজন শত্রুকে পরাভূত করতে পারে, সেখানে একটি গান সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করতে পারে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

যাহোক বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল রাজনৈতিক দর্শন, আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল উপজীব্য হাজার বছরের বাঙালির ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’। এ কারণেই সাময়িক রাজনৈতিক ভ্রান্তির দেয়াল খান খান হয়ে যায় বাঙালির সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দৃঢ়তায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রথমবারের মতো বাঙালি তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হয় নিজ ‘জাতিরাষ্ট্র গঠনের’, যোদ্ধা হিসেবে বাঙালি উজ্জীবিত হয় পরাধীনতার শিকল ভাঙার জীবন-মরণপণে। বাঙালি জাতি প্রস্তুত হয়ে ছিল স্বপ্নদ্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই অনবদ্য কাব্যিক আহ্বান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যেন হাজার বছরের বাঙালির প্রাণের গণসাংগীতিক উচ্চারণ। আনুষ্ঠানিক এই ‘ডাক’ সাংস্কৃতিকভাবে প্রস্তুত বাঙালি জাতিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করল তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। বাংলা ও বাঙালির জয়গানই ছিল সে যুদ্ধের মূলমন্ত্র। তাই তো গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার রচনা করলেন কালজয়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়/হবে হবে জয় নিশ্চয়ই/কোটি প্রাণ একসঙ্গে জেগেছে অন্ধ রাতে/নতুন সূর্য উঠার এই তো সময়।’

তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন গানগুলোকে চেতনাগতভাবে প্রধানত দুটি ধারায় ভাগ করা যায়Ñএক. মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা, জাতিপ্রেম এবং দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সংগ্রামভিত্তিক গান। দুই. যুদ্ধকালীন সংগ্রামী ও প্রেরণাদায়ক সংগীত যেখানে রয়েছে দেশ-জাতিকে রক্ষায় আত্মবলিদানে নিজেকে উৎসর্গের আহ্বান।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, ডিএল রায় প্রমুখের রচিত কবিতা ও গানগুলোও মুক্তিযুদ্ধের গান হিসেবে গীত হয়েছে। ‘চল্ চল্ চল্’/ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কিংবা ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’/আবার ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ কিংবা ‘ধন্য ধান্য পুষ্পে ভরা’ ... ইত্যাদি যে মুক্তিযুদ্ধের গান হিসেবে বিবেচিত হয়, তা কেবল মুক্তিযুদ্ধকালে রচিত তা নয়, বরং আবহমান বাঙালি জাতিসত্তার মূল চেতনাকে ধারণ করে সংগীতের যে ধারাটি বহমান ছিল তা এক নতুন ব্যঞ্জনায় সময়ের প্রেক্ষাপটে নতুন উপযোগিতা নিয়ে প্রতিভাত হয়। একই সঙ্গে ‘যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপট’ সৃষ্টির নতুন প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে।

নানা সময়ে বাঙালির গানে, কাব্যে বিভিন্ন ধর্মের ছোঁয়া লাগলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিভেদ, বৈষম্য কখনই তার সংস্কৃতিতে প্রকটরূপ ধারণ করেনি বরং সহাবস্থান, সহমর্মিতার এক অনুপম সম্মিলন দেখা যায় বাঙালির সাহিত্যে। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে নানা রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ মতো সাম্প্রদায়িক মতবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের জন্ম হলেও তা যে বাঙালি জাতির মনন ও মানসপটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না তা উভয় খণ্ডের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও রূপভিন্নতার মধ্যেই প্রতিভাত হয়। সংগত কারণেই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মাত্র ২৪ বছরের মাথায় ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর স্বভাবতই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বিভিন্ন ধরনের সংগীতের ধারা, যা যুদ্ধজয়ে বিজয়ী করেছে। আর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বঞ্চনার বিপরীতে বাঙালির মননে যে স্বাধীনতার মানসপট তৈরি হয়েছিল তা সংগীতের ব্যঞ্জনায় যোদ্ধাদের গতিশীল করেছে এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশ-বিদেশে তার আলো ছড়িয়ে মাত্র ৯ মাসে এনে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।

লেখক: পুলিশ সুপার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিমানবন্দরে পেটের ভেতর ইয়াবা বহনকালে মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার-নির্বাচন কোনোটা ঠিকমত করতে পারবে কিনা সংশয়: মঞ্জু
বিজয়নগর সীমান্তে পুশইনের চেষ্টা, বিজিবির টহল জোরদার 
গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ৩
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা