মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা সংস্কার কার্যক্রম

মো. মোস্তাফিজুর রহমান সাফি
  প্রকাশিত : ০৯ আগস্ট ২০২১, ১৫:১১
অ- অ+

বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি একটি কার্যকর শিক্ষানীতির অভাব প্রকট হয়ে উঠে, যা হতে হবে একই সাথে যুগোপযোগী এবং বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও আদর্শের চেতনাবাহী। কারণ পূর্বতন শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশক ধাঁচের শিক্ষানীতি একাত্তরের সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত দেশের জন্য ছিল মারাত্মকভাবে ধ্বংসকামী এবং চেতনাবিরোধী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল বাঙালিদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক, কল্যাণকামী, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। (১) স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি আধুনিক, কর্মমুখী, বিজ্ঞানমনস্ক এবং অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন, যা ছিল মূলত বাঙালি রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিভূমি।যেহেতু তিনি একটি জাতির উত্থানের সাথে জড়িত ছিলেন, সেহেতু সেই জাতিরাষ্ট্র গঠনের ঊষালগ্নে যে বিষয়গুলো তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছিল, তাদের একটি হচ্ছে শিক্ষা।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ৬টি প্রধান শিক্ষা কমিশনসহ মোট ৮টি শিক্ষা প্রতিবেদন পেশ করে। (২) কিন্তু কোনোটিতেই অখণ্ড পাকিস্তানের জাতীয় মুক্তি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি। তাই এত অল্পসময়ে বারবার শিক্ষানীতি পরিবর্তন করতে হয়। ঠিক এই কারণে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের সাথে শিক্ষা আন্দোলন জাতীয় মুক্তির বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রতিটি ছাত্র সংগ্রাম এবং শিক্ষা আন্দোলন যুগপৎ পথ চলেছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ব্রিটিশ শাসকদের ‘নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি’ কিংবা পাকিস্তানিদের ‘একপেশে গোষ্ঠী-স্বার্থ নীতি'র ঊর্ধ্বে এসে যুগোপযোগী, কল্যাণকামী ও সমাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষানীতিতে সমাজ, শিক্ষা ও মানুষ একীভূত হয়েছে একাত্তরের চেতনা, হাজার বছরে অর্জিত মূল্যবোধ, সামাজিক সংস্কার এবং আধুনিক জ্ঞানের বিশুদ্ধতায়। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার তিনদিন পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি এক ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মার্চ-ডিসেম্বরের সব ছাত্রের বেতন মওকুফ করেন। পরবর্তীতে শিক্ষক-কর্মচারীদের যুদ্ধকালীন ৯ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সারা দেশে ১৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬ হাজার উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা এবং ৯ শ কলেজ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই শিক্ষা ভবনগুলোর পুনঃনির্মাণ করে শিক্ষা উপযোগী করেছিলেন তৎকালীন সরকার। (৩) (৪) এভাবে দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধে বিপর্যস্ত জনগণের শিক্ষাসেবা নিশ্চিত করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সার্থকতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। স্বাধীনতার ১০ মাসের মাথায় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চারটি মূল স্তম্ভভিত্তিক জাতীয় সংবিধান প্রণীত হয়। মানুষের শিক্ষা অধিকার বিধিবদ্ধ করতে সেই সংবিধানের ১৫ ও ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে অবহিত করা হয়েছে। এরপর ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, (৫)

(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য।

(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য।

(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।

এছাড়া ২৮(৩) নম্বর অনুচ্ছেদ ও ৪১(২) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে সকল জনগণের শর্তহীন, বাধা বিপত্তিহীন, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে একাত্তরের চেতনা এভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাস্তবায়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। (৬) তিনি বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।‘

পাকিস্তান আমলের শাসকেরা শিক্ষার চেয়ে যুদ্ধ খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে বেশি পছন্দ করতো। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থাহীন একটা যুদ্ধবাজ জাতি গঠনের বিরোধী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে পাকিস্তানি দুঃস্বপ্ন ঘেরা সেই বিকারগ্রস্ত মানসিকতা থেকে জাতিকে মুক্ত করেন। এভাবে ৩০ জুন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষার চেয়ে শিক্ষা খাতে অধিক বরাদ্দ দিয়ে পাকিস্তান আমলের নিকৃষ্ট শিক্ষানীতি পরিত্যাগ করে একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়িত হয়। (৭) এরপর বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭২-৭৬) এর সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়ের একটি ছিল ‘শিক্ষা’। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষাই হলো সেরা বিনিয়োগ।

তাই তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই, মাধ্যমিক পর্যন্ত নারীদের অবৈতনিক শিক্ষা, ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ৪০ হাজার বিদ্যালয় সরকারিকরণসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নিরক্ষরতা দূরীকরণে জরুরি ভিত্তিতে আড়াই কোটি টাকা প্রদান করাও ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি সাহসী পদক্ষেপ। (৮) ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ সদস্যদের উদ্দেশ্য তাঁর শিক্ষা ভাবনার বিস্তারিত চিন্তা ভাবনা তুলে ধরেন। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বঙ্গবন্ধু প্রায় ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন।

১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৮ জুন এই কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট ও ১৯৭৪ সালের ৩০ মে বঙ্গবন্ধুর হাতে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট পেশ করে। (৯) সেই শিক্ষা কমিশন বেশ কয়েকটি মূল্যবান পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদান করে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল- শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো, নারী শিক্ষায় জোর দেওয়া, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ করা এবং শিক্ষার সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন করা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আরও দুটি শিক্ষাবিষয়ক আইন প্রণীত হয়। তা হলো- মাদ্রাসা এডুকেশন অর্ডিন্যান্স ১৯৭২, প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট ১৯৭৪। তিনি বলতেন- স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে যদি দুঃখী মানুষের জীবনমানের উন্নতি না হয়। (১০) সংখ্যায় সমাজের অর্ধেক নারী হলেও নারী শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। বঙ্গবন্ধু নারীদের জন্য শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বৃত্তিমূলক করার প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। (১১) ফলশ্রুতিতে আজ আমরা নারী শিক্ষার আমূল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনায় দূরদর্শিতার জন্য। একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়নে শিক্ষা-উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সর্বাধিক শ্রম ও সৃজনশীলতা দিয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর সুবিশাল শিক্ষা ভাবনা লক্ষ্য করা যায়। তিনি ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের পাশাপাশি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ যেন নিজেরা নিজেদের অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী পরিচালিত করতে পারে, সেজন্য আইয়ুব খানের ‘কালো আইন’ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। (১২) কারণ একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো জ্ঞান প্রজাতন্ত্রের আর কোনো প্রতিষ্ঠানের থাকতে পারে না। গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মেডিকেল, প্রযুক্তি ও কারিগরি বা বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে তাঁর শিক্ষা সংস্কার ভাবনা ছিল কতটা দূরদর্শী, উদারনৈতিক এবং মর্যাদাশীল।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা ও দর্শনকে ধারণ করে যেকোনো জাতি একটি আধুনিক, কর্মমুখী এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। এ কারণেই তার শিক্ষা ভাবনা ‘জাতীয়’ থেকে ‘বৈশ্বিক’। বাংলাদেশ উত্তরোত্তর যে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার সাড়ে চার বছরের মধ্যে বিপথগামীদের হাতে তিনি শহীদ না হলে আজকের বাংলাদেশ আরো কয়েক গুণ উন্নত হতো সন্দেহ নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইইই বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকাটাইমস/৯আগস্ট/এসকেএস

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সোনারগাঁয়ে বিএনপির প্রচারপত্র বিলি অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের ঢল
মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডে বিএনপিকে জড়ানো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র: আমিনুল হক
প্রকাশ্যে মাথা থ্যাঁতলে হত্যা: ‘ফাইসা গেছি’, বললেন রবিন
অকাল মৃত্যু ঠেকাতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংস্কার জরুরি: ১৯ সংগঠন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা