বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু

বাঙালির কোনো ইতিহাস নেই। কথাগুলো সখেদে বলেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই খেদ, মনস্তাপ ও বেদনা কেবল বঙ্কিমচন্দ্রের একারই ছিল না, ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের, নেতাজি সুভাষ বসুর, ছিল কোটি কোটি বাঙালির। বাঙালির শত শত বর্ষের পুঞ্জীভূত কালিমা, গ্লানি ও অপবাদের অপনোদন করতে আবির্ভূত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি ও বাংলাভাষীদের জন্যে তিনি সৃষ্টি করলেন ইতিহাস। সে ইতিহাস একাধারে অনুপম ও বীরত্বব্যঞ্জক। উপহার দিলেন স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি। সবুজের প্রেক্ষাপটে উদীয়মান রক্তিম সূর্যখচিত পতাকা। মাতৃভাষায় কথা বলার অবাধ অধিকার। বিশ্ব সভায় পরিচিতি। বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গ্রথিত। অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য। শ্রেষ্ঠতম বিশ্ব নেতৃত্বের পঙ্ক্তিভুক্ত হলো তাঁর নাম। উচ্চারিত হলো জর্জ ওয়াশিংটন, লেনিন, মহাত্মা গান্ধী, মাও সে তুং, হো চি মিন, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখের নামের সাথে। বঙ্গবন্ধু আমাদের গৌরব। আমাদের অহংকার।
প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে তারা নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয়েছিল দৈহিকভাবে। তাঁকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল কোটি কোটি মানুষের হৃদয় থেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব ও অমর। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন ৫৫ হাজার বর্গমাইলের সবুজ শ্যামল এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে। বাংলাদেশের মতোই শাশ্বত চিরায়ত ও দেদীপ্য বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব। বাংলাদেশকে মুছে ফেলতে না পারলে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
এই সত্য বিস্মৃত হয়ে অপগণ্ডের মতো ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টায় যারা লিপ্ত, তারা বাস্তবিকই করুণার পাত্র। বঙ্গবন্ধুর সুমহান আদর্শের সৈনিক ও অনুসারী হিসেবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আমার এই আকিঞ্চন প্রয়াস। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নই এর লক্ষ্যে।
বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার বিষয়ে ছয়টি তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার আলোচনা শুরু করতে চাই। যে ছয়টি উদ্ধৃতি দেব তা বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিহাসনির্ভর এবং যাদের উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে তাদের আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর সমর্থক বলে তাদের অতি বড় শত্রুও চিহ্নিত করতে পারবে না। উপরন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক এবং এদের দুজন আবার তার জানি দুশমন বলে চিহ্নিত।
আমার প্রথম উদ্ধৃতি প্রখ্যাত প্রয়াত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস-এর ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’ থেকে। যাদের সুযোগ হয়েছে বইটি পড়ার তারা জানেন এতে বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থের এক জায়গায় ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন, “পাঞ্জাবী রাজনীতিবিদদের শঠতায় অতিষ্ঠ হয়ে আওয়ামী লীগ ফিরোজ খান নূনের পক্ষ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়। শেখ মুজিব সেদিন অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলে ফেলেন, “আমাদের স্বাধীনতা পেতে হবে।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের নিজেদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীও থাকতে হবে। আমি অবশ্যই এসব দেখব।” (বাংলা অনুবাদ, রনাত্রি পৃ. ১১২)। ম্যাসকারেনহাস বর্ণিত এই উক্তি যখন বঙ্গবন্ধু করেন তখন সময় ১৯৫৮ সাল। ফিরোজ খান মন্ত্রিসভার পতন হয়েছে এবং আই আই চুন্দ্রিগড় সরকার তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ১৯৫৮ সালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন।
দ্বিতীয় উদ্ধৃতি সংযুক্ত পাকিস্তানের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান থেকে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালের বেতার ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, “ঐ ব্যক্তি (মুজিব) ও তার দল পাকিস্তানের দুশমন। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে সার্বিকভাবে পাকিস্তান থেকে পৃথক করতে চায়। এবার তাকে শাস্তি পেতেই হবে।” (২৬শে মার্চ, ১৯৭১ ইয়াহিয়া খানের ভাষণের বাংলা অনুবাদ থেকে)। এ কথা সবার জানা ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার সব ব্যবস্থাই সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু সময়াভাবে অর্থাৎ তার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হওয়ায় সেটা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ইয়াহিয়া খান কথিত ‘সার্বিকভাবে পৃথক করা’ (টোটাল সিসেশন) কি স্বাধীনতা নয়?
আমার তৃতীয় উদ্ধৃতি ’৭১ সালে নরহত্যার জল্লাদ বেলুচিস্তানের কসাই জেনারেল টিক্কা খান থেকে। টিক্কা খান স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছে- Mujib had sent messages to all the Bengali army officers...on 23rd and later on 26th March to revolt. They revolted first at Joydevpur and later in Chittagong. অর্থাৎ মুজিব ২৩শে মার্চ ও ২৬শে মার্চ সকল বাঙালি সেনা অফিসারকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বিদ্রোহ করার জন্য। তারা প্রথমে জয়দেবপুরে ও পরে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে।
টিক্কা খান এ কথাগুলো বলেছিলেন ‘নিউজ ডে’পত্রিকার সম্পাদক এবিএম মূসাকে, ঘটনার প্রায় দু’ দশক পরে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে। টিক্কা খানেরই এসব জানবার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দমন করার জন্যই তাকে তখন পাঠানো হয়েছিল ঢাকায়।
টিক্কা খান বর্ণিত চট্টগ্রামে সেনা বিদ্রোহে জড়িত মরহুম জিয়াউর রহমান এ প্রসঙ্গে কী বলেছেন এখন আমরা তা-ই দেখব। ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন ও আজকের প্রেক্ষাপট’ (সম্পাদনায়: সফিকুর রহমান সফিক) গ্রন্থে ‘যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল’ শীর্ষক জিয়াউর রহমানের একটি লেখা সংকলিত হয়েছে। এটি ১৯৭২ সালে লেখা এবং তা প্রথম সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। এতে তিনি লিখেছেন, “৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম।”
এই ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ও ‘চূড়ান্ত রূপ’ জিয়া যে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছেন, তা তিনি স্বয়ং অকপটে স্বীকার করেছেন। জিয়ার প্রসঙ্গে আমার বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আরো বিস্তারিত আলোচনা করব। তথ্য প্রমাণাদির মাধ্যমে দেখাব কীভাবে তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে, জাতির জনকের আগে শ্রদ্ধাভরে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ যোগ করে সরবে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের মাধ্যমে বেতারে একাধিকবার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।
জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। তারই কমান্ডে জিয়া যুদ্ধ করেছেন। জিয়া প্রসঙ্গে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘সান রাইজ’ পত্রিকার (নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যা, ১৯৮০) এক সাক্ষাৎকারে ওসমানী বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি। বঙ্গবন্ধুই ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ, জেনারেল ওসমানী যখন এই সাক্ষাৎকার দেন তার বহু আগেই তিনি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের সাথে প্রকাশ্যে সকল সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী মোশতাকের সাথে তিনি কিছুদিন তার সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সাফাই গাওয়ার তার কোনোই প্রয়োজন ছিল না।
আমার সর্বশেষ উদ্ধৃতি জেনারেল জিয়ার এককালীন উপপ্রধানমন্ত্রী, পরবর্তীকালে এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের “Era of Sheikh Mujibur Rahman” গ্রন্থ থেকে। মওদুদ লিখেছেন “Mujib is the greatest phenomenon of our history... His death was not his end. He will continue to remain as a legend in the political life of Bangladesh. Bengalis might have had leaders in their history more intelligent, more capable and dynamic than Sheikh Mujib but none gave so much to the Bengalis political independence and a national identity. It is Mujib who in the end was able to identity himself not only with the cause of Bengalis but with their dereams. He became the symbol of Bengali nationalism which gave birth to an independent and sovereign identity... The fact that there is a country called Bangladesh is a sufficient testimony to Mujibs status as a legend of our age” মওদুদ যখন এ কথাগুলো লেখেন এবং তাঁর পুস্তিকাটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন তিনি জিয়াউর রহমানের বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালে মওদুদ তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন এবং এ জন্য তাকে কিছুদিন কারাবাসেও কাটাতে হয়। তা সত্ত্বেও সত্যকে আড়াল করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। গোটা বইটি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনের সমালোচনা মুখর।
রুডলফ সম (Rudolph Som) ১৮৯২ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ কিরশেনরেখত (Kirehnrechit) এ সর্বপ্রথম ‘ক্যারিশমা’ (Charisma) বা জাদুকরী নেতৃত্ব শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ম্যাক্স ওয়েবার (Max Waber) রাজনীতির পরিভাষায় শব্দটি সংযোজিত করে এর নতুন তাৎপর্য দেন। Revolutionary (বৈপ্লবিক) বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। Charisma is alien to the word of everyday routine, it calls for new ways of life and thought... The charismatic leader is not simply any who is idolozed and fiecly followed for his extra-ordinary leadership qualities. but one who demostrates such qualities in the process of summoning people to join in a movement for change and in leading such a movement (Robert C Tucker: The theory of Charismatic Leadership and Max Weber-Theory of Social and Economic Organization). জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে এই ক্যারিশমারই যথার্থ প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। শত শত বছরের পরাধীন হতাশাগ্রস্ত দারিদ্র্যপীড়িত শিক্ষা-দীক্ষা বঞ্চিত মৃতপ্রায় বাঙালি জাতিকে তিনি তাঁর জাদুকরী নেতৃত্বের জীবনস্পর্শে উদ্দীপিত ও অনুপ্রাণিত করে তুলছিলেন। অশ্রুর সাগর ও রক্তের নদী সাঁতরে তারা তারই সুমহান নেতৃত্বে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। বাঙালি জাতিকে তিনি দিয়েছেন একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, রক্তিম সূর্যখচিত জাতীয় পতাকা। দিয়েছেন প্রাণভরে নিজেদের জাতীয় সংগীত গাইবার অসীম আনন্দ।
বিশ্বে বাঙালি লাভ করলো স্বতন্ত্র ও স্বকীয় জাতিসত্তার পরিচিত ও গৌরব। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা তাই একসূত্রে গাঁথা।
বঙ্গবন্ধুর এই বিজয় গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে কী করে তিনি এই অসাধ্য সাধন করলেন, তা স্বচক্ষে দেখার জন্য যুগোস্লাভিয়া থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন এ যুগের আরেক মহান বিপ্লবী নেতা, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যোশেফ ব্রজ টিটো, সংক্ষেপে মার্শাল টিটো। এসেছিলেন ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক জগতের একদা প্রধান ব্যক্তিত্ব ও সংস্কৃতি মন্ত্রী সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। এসেছিলেন আরো অনেকে বঙ্গবন্ধু দর্শনে। তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও বিজয় হয়ে দাঁড়ালো প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধু হলেন বিশ্বের সর্বাধিক উচ্চারিত একটি নাম। জুরিখ থেকে প্রকাশিত ‘নয়ে জুরখার সাইতুং’ লিখলো- ‘বঙ্গবন্ধু ইস্ট দেয়ার আইন সিগে’ (বঙ্গবন্ধু বাস্তবিকই অনন্য)
’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন তখন তাঁকে সমবেত নেতৃবৃন্দ বীরোচিত সংবর্ধনা দেন। ’৭৪ সালে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলন ও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে অনুরূপ অভিনন্দন ও সংবর্ধনা লাভ করেন। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে তিনি আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভূষিত করেন। বিশ্ব ফোরামে এই প্রথম উচ্চারিত হলো বাংলাভাষা। রবীন্দ্রনাথের পরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন করে মাতৃভাষার মর্যাদা আর কেউ বৃদ্ধি করতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু যে কী পরিমাণ স্বাধীনচেতা ছিলেন, দেশের মর্যাদাকে যে সবার ওপরে স্থান দিতেন, এর ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময়ে বঙ্গবন্ধু দেখতে পান তাঁর জন্যে ভারতীয় বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশ ওয়ারওয়েজ বিমান ব্যবহার করেন। কারণ, তখন ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। দিল্লিতে যাত্রাবিরতির সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের সময়ে তিনি প্রথমে যে বিষয়টি উত্থাপন করেন, তা তাঁর আপোসহীন ভূমিকার জন্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়া হয়। অথচ তখনো দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি। বঙ্গবন্ধুর জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
১৯৭৩ সালে লাহোরে ইসলামী ঐক্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর শর্ত ছিল আগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দিতে হবে। স্বীকৃতি আদায় করে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত এবং পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের মধ্যস্থতায় (এদের দু’জনই তখন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে সাথে করে নেওয়ার জন্যে ঢাকায় এসেছিলেন) তিনি ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় দেশের মর্যাদা ও সম্মানকে তিনি কতটুকু ওপরে স্থান দিতেন। ইসলামী উম্মাহভুক্ত হওয়া এবং আরব বিশ্বের সাথে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রয়াসকে ভারত ততটা সুনজরে দেখেনি। তা সত্ত্বেও ভারতের মনোরঞ্জনের জন্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেননি। সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ তিনিই নিয়েছিলেন। সৌদি আরবের তদানীন্তন বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ মানব’ হিসেবে। ভারত ও রাশিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি গণচীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে যান। কিসিঞ্জারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিকসনের তীব্র আপত্তি জানানো সত্ত্বেও কিউবার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা যেমন ফারাক্কার পানি (৪৪ হাজার কিউসেক-বর্তমানে যা দশ হাজার কিউসেকও নয়), লাঠিটিলাসহ একাধিক ছিটমহল আদায় (দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার চুক্তি তাঁর সময়েই হয়েছিল), সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি ইত্যাদি বঙ্গবন্ধুরই কৃতিত্ব।
স্বাধীনতা অর্জনে যেমন তেমনি দেশ গঠনেও তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত প্রশাসনবিহীন একটি দেশের দায়িত্ব নেওয়া এবং পরিচালনার সুকঠিন চ্যালেঞ্জ বঙ্গবন্ধু সাহসিকতার সাথে গ্রহণ ও মোকাবেলা করেন। এক বছরের মধ্যে দেশকে তিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী একটি সংবিধান উপহার দেন। প্রশাসন গড়ে তোলেন। সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ বাহিনী গঠন করেন। দেশের একমাত্র সামরিক একাডেমি তাঁরই গড়া। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। পাকিস্তানে আটকে পড়া নাগরিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গকে আর্থিক সাহায্য প্রদান ও নির্যাতিতা মা-বোনদের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁর সরকার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন এবং আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। হার্ডিঞ্জ ও ভৈরব সেতুসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরি, ১৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগি, ৪৬০টি বাস, ৬৫০টি নৌযান ও ৩টি পুরাতন বিমান চালু করে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন রেকর্ড সময়ের মধ্যে। তাঁর আমলেই অচল নদী ও সমুদ্রবন্দরসমূহ আবার চালু করা হয়। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বিমা ও ৫৮০টি (যাদের অধিকাংশই ছিল দেউলিয়া ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত) উৎপাদনক্ষম প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে চালু করার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর রুটি-রুজির সংস্থান করেন। নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটিয়ে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দিকনির্দেশনায় কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। জিডিপি বৃদ্ধির হার তখন ছিল সাত ভাগের মতো। সরকারি কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল ও সাংবাদিকদের প্রথম বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বঙ্গবন্ধুই প্রথম ঘোষণা করেন।
মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা বোর্ড গঠন, পবিত্র হজব্রত পালনে সরকারি অনুদান প্রদান, তাবলিগ জামাত অনুষ্ঠানের জন্যে জায়গা দান ইত্যাদির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার প্রয়াসী হন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষা প্রসারে জাতির জনক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ প্রণয়ন, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ, ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা, বহুসংখ্যক স্কুল ও কলেজের জাতীয়করণ এবং শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে কুদরাত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ইত্যাদি। কৃষক ও কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল পাকিস্তান আমলের বকেয়া খাজনাসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে মওকুফ, কয়েক লাখ কৃষিঋণের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, চাষিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণদান নিশ্চিত করা, ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বিতরণ, বিনামূল্যে কীটনাশক ওষুধ, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিদানের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে সার, বীজ ও যৎসামান্য ভাড়ায় পাওয়ার পাম্প ও গভীর নলকূপ সরবরাহ ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদসহ ১৪০টি দেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্তি নিঃসন্দেহে একটি বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুই প্রথম দেখেছিলেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের জন্যে তাঁকে জুলিও কুরি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এভাবে দেশে-বিদেশে যখন বঙ্গবন্ধু নবলব্ধ স্বাধীনতা সুসংহত করতে থাকেন, অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে কার্যক্রম যখন সুচারুভাবে সম্পন্ন প্রায়, কল-কারখানা, ক্ষেতে-খামারে যখন উৎপাদন শনৈ শনৈ বৃদ্ধি পাচ্ছে, মুদ্রানীতি ও সংস্কারের ফলে যখন দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল হচ্ছে, অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে এবং শিল্পায়নে গতি সঞ্চারিত হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে এবং প্রশাসন গণমুখী ও উন্নয়নমুখী হয়ে উঠছে ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি স্বার্থবিরোধী গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তার বিরুদ্ধে আঘাত হানে আমাদের অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার মানসে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে সারা বিশ্ব শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামীর এই করুণ পরিণতি বিশ্ব বিবেককে সংক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত করে তোলে। পশ্চিম জার্মানির নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রাষ্ট্রনায়ক উইলি ব্রান্ট সখেদে মন্তব্য করেছিলেন, ‘কিলিং অব মুজিব ইজ অ হিনিয়াস ক্রাইম’ (মুজিব হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ)। লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’ সম্পাদকীয় মন্তব্য করেছিল ‘ইফ দ্যাট ওয়াজ দ্য ইনইভিটেবল ফেইব অব শেখ মুজিব দেন বাংলাদেশ শুড নট হ্যাব বিন বর্ন’ (এই যদি হয়ে থাকতো শেখ মুজিবের নিয়তি তাহলে বাংলাদেশের জন্মের আদৌ প্রয়োজন ছিল না)। ‘টাইম’ ম্যাগাজিন তাকে আখ্যায়িত করেছিল ‘মহান ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে। ‘গার্ডিয়ান’ অবিচুয়ারি বা শোক বাণীতে লেখে- ‘মহান ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে। ‘গার্ডিয়ান’ অবিচুয়ারি বা শোক বাণীতে লেখে ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক অলৌকিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ।’ শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক বলেছিলেন-‘শেখ মুজিবের মর্মান্তিক মৃত্যু মানবাধিকারের মৌল আদর্শের পরিপন্থী।’ ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সম্মেলনে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা কি এত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল?’ আনোয়ার সাদাত নাকি আক্ষেপ করেছিলেন, কেন তাঁর বন্ধু মুজিবকে ট্যাংক বহর উপহার দিতে গিয়েছিলেন। সাদাতের উপহার দেওয়া সেই ট্যাংকের জোরেই ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর প্রাণ কেড়ে নেয়।
স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি লাগাতার চেষ্টা করেও তাঁর নাম মুছে ফেলতে পারেনি। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে শহীদ বঙ্গবন্ধু ক্রমেই অধিকতর শক্তিশালী হয়ে আত্মপ্রকাশ করছেন। তাঁর স্থান জনতার হৃদয়ে, মনের মণিকোঠায়। যত দিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে, যত দিন উড্ডীন থাকবে বাংলাদেশের পতাকা, প্রতিদিন একজন বাঙালিও জীবিত থাকবে- তত দিন মৃত্যু নেই বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির শতাব্দীর মহামানব। শতাব্দীর পর শতাব্দী তিনি অক্ষয় অমর হয়ে থাকবেন। প্রেরণা দেবেন, উদ্দীপনা জোগাবেন।
লেখক: বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ ও দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী।

মন্তব্য করুন