‘শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও সিলেবাসে পরিবর্তন প্রয়োজন’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৩৬
অ- অ+

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে সিলেবাস রয়েছে এর মধ্যে আরও ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদেরা। তারা বলছেন, শিক্ষাকে বিশ্বমানের এবং দেশীয় সংস্কৃতিকে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করতে আগামীর শিক্ষা খাতে আর্থিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাহলে আমাদের দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য সবকিছুর উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এতে দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানে, বাণিজ্যে উন্নয়ন হবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিবার্তা২৪ডটনেট ও জাগরণ (আইপি) টিভির আয়োজনে ‘আগামীর বাংলাদেশ: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

জাগরণ আইপি টিভির প্রধান সম্পাদক এফএম শাহীনের সঞ্চালনা এবং বিবার্তা২৪ডটনেট সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসির সভাপতিত্বে গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি।

অনুষ্ঠানে কি-নোট স্পিকার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহম্মদ হুমায়ুন কবির। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নত ছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ইতিহাস নষ্ট করার চক্রান্ত করা হয়েছিল। পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিক্ষাব্যবস্থাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশ ১৩ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এছাড়া বাঙালি সংস্কৃতি নষ্ট করে ইংরেজি সংস্কৃতি ধারণ করা হচ্ছে। এই সংস্কৃতিকে দূর করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।

গোলটেবিলে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ গড়ার ভাবনা করেছিলেন। যুদ্ধের পর সীমিত সম্পদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। এক লাখ ৪০ হাজারের মতো শিক্ষককে সরকারিকরণ করেছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে গোটা জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা হয়েছিল। সে সময়ে আঘাতটা শিক্ষার ওপরও এসেছিল। এরপর বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে প্রাইমারি, হাইস্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থার অধঃপতন ঘটেছিল। মেধাহীন শিক্ষকদের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের সমাজে নীতি-নৈতিকতার অনেক অবক্ষয় হয়েছে। অনৈতিকতা প্রতিরোধ করার জন্য নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আমাদের এতোই দুর্ভাগ্য, অনৈতিক কাজকে কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সেজন্য নতুন নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো রোধ করার চেষ্টা করতে হচ্ছে। প্রাথমিকে শিক্ষায় নীতি-নৈতিকতা শিখাতে পারলে আমরা এই অনৈতিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারবো। শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই নৈতিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আমরা আজ বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছি। জ্ঞান চর্চার মধ্যে স্বাধীনভাবে চিন্তা, বক্তব্য উপস্থাপন, স্বাধীনভাবে সিলেবাস তৈরি করে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে শিক্ষাকে আবহমান সংস্কৃতির সাথে নিয়ে আসার জন্য ’৭৩ এর আইন। সেটা হচ্ছে কিন্তু এর পাশাপাশি আমরা পত্র-পত্রিকায় নানা ধরনের খবরে দেখি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের বিত্ত-বৈভব অর্জনের অপচেষ্টার দিকে ইঙ্গিত দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে ’৭৩-এর অধ্যাদেশ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশাসনিক ক্ষমতার জন্য, আর্থিক বিষয়ে কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে ফাইনান্সিয়াল ল’ রয়েছে। এসব আইনের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করছি। এসব অসঙ্গতি দূর করাই বড় বাধা।

ড. সামাদ বলেন, শিক্ষার সাথে ক্ষমতায়নের সম্পর্ক আছে। আমাদের সময়ে এক ধরনের শিক্ষা ছিল। একই জ্ঞান অর্জন করার ফলে তখন প্রতিযোগিতা হতো। চাকরি, শিক্ষকতায় বিভিন্ন জায়গায় সমানভাবে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের পরে যখন সামরিক শাসন এলো শিক্ষার মধ্যে বৈষম্য তৈরি হলো। এই বৈষম্য তৈরির ফলে গ্রামের ছেলেরা যারা প্রাইমারি স্কুলে, গ্রামের স্কুলে পড়েছে তারা কিন্তু সেইভাবে ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে অংশ নিতে পারছে না। চাকরি, রাজনীতি, ব্যবসায় সেইভাবে ঢুকতে পারছে না। এর কারণ সমাজে যাদের বিত্ত-বৈভব আছে তাদের আর্থিক সক্ষমতা থাকায় ভালো স্কুলে, কলেজে পড়েছে। সমাজের মূল ক্ষমতা তাদের হাতে। এটা বড় ধরনের বৈষম্য। সমাজে সমতাভিত্তিক শিক্ষা নেই। সমাজে নানা উত্থান-পতন সমস্যা তৈরি হয়েছে। যার কারণে সমাজেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমরান কবির চৌধুরী বলেন, আমি মনে করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব রিসোর্স আছে আমরা সেটার যথাযথ ব্যবহার করতে পারছি না। বরং আমরা আমাদের রিসোর্সের অপব্যবহার করছি। সমস্যাটা আমাদের নিজেদের মধ্যে। আমাদের মানসিকতার সমস্যা। যার যেখানে দায়িত্ব সেখানে পালন করা হচ্ছে না। পিএসসির মাধ্যমে যেমন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়, ঠিক একইভাবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া যায়, আমি মনে করি তাহলে স্বচ্ছতা আসবে। এটা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৯০ ভাগ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। নিয়োগ এবং টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে যদি ভাইস চ্যান্সেলরদেরকে বাইরে রাখা য়ায় তাহলে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমস্যা থাকবে না।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, মীমাংসিত বিষয়গুলোতে যখন আঘাত আসে, তখন একটি জাতির চেতনার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। জাতির জনক যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণার মাধ্যমে দেশকে ঢেলে সাজানোর স্বপ্ন দেখছিলেন। ১৫ আগস্ট ঘটানো হয়েছিল সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল বাঙালির আবেগের সাথে বেঈমানি করে, ‘৭২ এর সংবিধানের জাতীয় চার নীতিকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য। বঙ্গবন্ধুর এই সামাজিক বিপ্লবকে ধ্বংস করার পেছনে যেমন পরাজিত শক্তি পাকিস্তান দায়ী, ঠিক তেমনি তৎকালীন সেনা শাসন, দেশীয় ষড়যন্ত্র এমনকি চীন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিগুলোও দায়ী। আমরা কিন্তু এখনো সেই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পেছন পেছনই ছুটছি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন বলেন, স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাগ নিয়ে আদালতের একটি রায় রয়েছে। তারপরও স্কুল ব্যাগের ওজন থেকে এখনো রেহাই পাচ্ছে না শিশুরা। আমাদের দেশে আদালতের রায়ও এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে।

আব্দুল জব্বার খাঁন বলেন, যারা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে কর্মরত আছেন, তারা সবাই সরকারের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। কিন্তু শুধু প্রশাসন ক্যাডারে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে শিক্ষাসহ সকল ক্যাডারকে সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়া আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, আমাদের দেশে প্রত্যেক জেলায় একটা করে বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে। শুনতে ভালো লাগে। অনেক জায়গা ন্যূনতম একটা অবকাঠামো এবং শিক্ষার পরিবেশ তৈরি না করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার মান পড়ে যাচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকদেরকে বেতন কাঠামোর দিক দিয়ে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে আসা দরকার। প্রাইমারি পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে সিলেবাস রয়েছে এর মধ্যে আরো ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশে তিন ধরনের সিস্টেমে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একেবারে প্রাইমারি লেভেল থেকে সেক্স এডুকেশন, জেন্ডারের ওপর কোস যুক্ত করা প্রয়োজন। যেগুলো আসলে যোগ্য শিক্ষার্থী, নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে কাজে দেবে।

তানিয়া হক বলেন, শিক্ষার কারিগর হচ্ছে শিক্ষক। সেই শিক্ষকদের জবাবদিহিতার একটি জায়গা তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। এটা করা সম্ভব হলে শিক্ষা পদ্ধতিকে আমরা পরিচিত করতে পারবো।

সভাপতির বক্তব্যে বিবার্তা২৪ডটনেট সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমরা কেউই সমালোচনা শুনতে পছন্দ না করলেও এখানে উপস্থিত সকল বক্তাই আত্মসমালোচনা করেছেন। আত্মউপলব্ধি থেকেই মানুষ আত্মসমালোচনা করে। তাই আমার বিশ্বাস সমস্যার সমাধান হবেই।

হাসি বলেন, শুধুমাত্র বড় বড় ইমারত, কালভার্ট, ব্রিজ, ফ্লাইওভার এগুলো উন্নয়ন না। যদি আমাদের মধ্যে মানবিক বোধের জায়গা ঠিক না হয়। মানবিক সমাজ, মানবিক প্রজন্ম তৈরি করে এমন শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করা দরকার।

(ঢাকাটাইমস/১৮নভেম্বর/কেআর/জেবি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পাবনায় বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ: মোটরসাইকেল ও অফিস ভাঙচুর, হাসপাতালে ভর্তি ৫
বিএনপি মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চায়: আমিনুল হক 
অভ্যুত্থানের পর সরকারের কর্তব্য ছিল শিক্ষাখাতের সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া: সাকি
৫ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করেছে বিএসএফ 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা