ভালো শেয়ারের দাম কমলে বাড়ার সম্ভাবনাও থাকে

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, এফসিএমএ
 | প্রকাশিত : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৩৯

পুঁজিবাজার সম্পর্কে বেশ কিছু কথা প্রচলিত আছে। যেমন, এখানে বিনিয়োগ করে দ্রুত ধনী হওয়া যায়, আবার এখানে বিনিয়োগ করে টাকা হারায়, টাকা নিয়ে কেউ ঘরে আসতে পারে না। আবার এমনও প্রচলিত আছে, এটা একটা জুয়ার মতো। এগুলোর কোনোটাই যেমন সর্বাংশে সত্য নয়, তেমনি সর্বাংশে মিথ্যাও নয়। তবে পুঁজিবাজার একটা নিয়ম-কানুন আর জানার জায়গা, জুয়ার কোনো নিয়ম-কানুন ওভাবে নেই।

জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করলে লাভের সম্ভাবনা বেশি, আর না জেনে বিনিয়োগে লোকসান তো হবেই। তাহলে জানতে হবে কেন পুঁজিবাজারে টাকা হারায়, আর কীভাবেই বা লোকসানের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যায়।

১. পুঁজিবাজার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা না থাকা

প্রথমত, অনেকে পুঁজিবাজারে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করতে আসেন, কিন্তু পুঁজিবাজার সম্পর্কে সাধারণ প্রাথমিক জ্ঞানও নেই। তো একজন কৃষক, যিনি জমি চেনেন না, সার চেনেন না, বীজ চেনেন না, তিনি যদি চাষাবাদ করতে যান তার কি ফলন হবে? যখন পানি দেয়ার কথা সামান্য, তখন তিনি জোয়ারের মতো ভাসিয়ে দিলেন, তাহলে ফল তো হবে না। এই একটা ভুল বহু বিনিয়োগকারী করেন। পুঁজিবাজার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা না নিয়ে বিনিয়োগ করেন। এ জন্য আমি বলব পুঁজিবাজারে যারা বিনিয়োগ করতে আসেন, তারা পুঁজিবাজার সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারণা নিন। প্রাথমিক ধারণা যত দিন পর্যন্ত আপনার না হবে তত দিন পর্যন্ত আইপিওতে (IPO) আবেদন করুন।

আইপিওতে শেয়ার পেলে, তা যদি ভালো হয় তবে রেখে দিতে পারেন, না হলে বিক্রি করে লাভ তুলে নিতে পারেন। এ ছাড়া বাজার সম্পর্কে না বুঝে কারও পরামর্শে পুঁজিবাজারে এলে আপনার লাভ করার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বিনিয়োগ করতে গিয়ে কেউ বলল এটা কিনলে লাভ হবে, আপনি এটা কিনে ফেললেন, সেটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ না।

সে জন্য আমরা বলব, পুঁজিবাজার সম্পর্কে পড়াশোনা করে, পারলে দু-একটা ট্রেনিং প্রোগ্রাম করে যদি বিনিয়োগ করতে আসেন তাহলে লাভ করতে পারবেন।

২. ব্রোকারেজ হাউজ নির্বাচনে ভুল করা

দ্বিতীয়ত, ব্রোকারেজ হাউজ নির্বাচনেও অনেকে ভুল করে। বাসার কাছে বলে সেটাতে অনেকে যান। আবার কমিশন সবচেয়ে কম নেয় এমন ব্রোকারেজ হাউস বেছে নেন। সবই ঠিক আছে, কিন্তু আপনার পারপাস সার্ভ করবে কে সেটা দেখতে হবে। পুঁজিবাজারের একটা বিষয প্রচলিত রয়েছে, যে কমিশন কম নেয় তার ওখানে অ্যাকাউন্ড করবে। কমিশন কম নেয় এটা যদি সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া হয়, তাহলে আপনি একই মাছ সবচেয়ে কম দামে যেটা কিনবেন সেটা তো হবে পচা। সেগুলো তো আপনি কেনেন না। আপনাকে মিনিমাম একটা স্ট্যান্ডার্ড ব্রোকার সিলেক্ট করতে হবে।

৩. গুজবে শেয়ার কেনাবেচা করা

গুজব যে পুঁজিবাজারে কী হারে বেচাকেনা হয়! শোনা যায় পয়সার বিনিময়েও গুজব বেচাকেনা হয়। ‘আমি আপনাকে আইটেম একটা সিলেক্ট করে দিব যা লাভ হবে আপনি আমাকে এত দিবেন।’ তো যারা এমন গুজব বেচাকেনা করেন, ওরা যদি আপনাকে একবারেই লাভ করে দেন তাহলে উনি সেকেন্ড টাইম গুজব বিক্রি করবেন কীভাবে? দশটা আপনাকে সিলেক্ট করে দিলে একটা লাগবে, বাকি নয়টাতেই লোকসান হবে। তো সেটার হাত থেকে দূরে থাকতে হবে।

৪. সব টাকায় একই শেয়ার কেনা

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা বললে পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্টের প্রশ্নটা আসে। পোর্টফোলিও কী সেটাও জানতে হবে। সব টাকা দিয়ে একটা অথবা দুটা কোম্পানির শেয়ার কিনলে, ঝুঁকি বেশি থাকে। কেনা শেয়ারটার দাম যখন কমে যায়, তখন বিনিয়োগকারীর পালপিটেশন শুরু হয়, আরও দাম কমে যাবে ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে লোকসান মেনে নেন। একাধিক কোম্পানির শেয়ার থাকলে এমনটা হতো না। একটা লসে পড়লেও অন্যটার লাভে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে।

৫. লোনের টাকায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ

আরেকটা কমন মিসটেক- নিজের টাকা ঠিক ঠিকভাবে বিনিয়োগের আগেই মার্জিন লোন নেওয়ার আগ্রহ। আরে বাবা লোন নেবেন, কিন্তু নিজের টাকা বিনিয়োগ করার নিয়ম-কানুন আগে শিখতে হবে। আপনি লোন নিলে তো ডাবল রিস্ক। যত দিন পুঁজিবাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞ না হবেন তত দিন লোনের ধারে-কাছেও যাবেন না। পুঁজিবাজারে লোনের ব্যবস্থা আছে, সেটা বাজারে তারল্য বাড়ানোর জন্য, এটা ঠিক। কিন্তু আপনাকে লোন নেওয়ার আগে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে, ঝোঁকের মুখে ঋণে জড়াবেন না।

৬. তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখা

পুঁজিবাজারে এলে ওভারনাইট প্রফিট করা যাবে এবং তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়া যাবে- এই দুইটার মধ্যে দুটি ভুল ধারণা। বিনিয়োগের একটা সময় আছে এবং সেই সময়টা কখন আসে, কখন শুরু হয়, কখন শেষ হয় সেটা জানতে হবে। যেমন রেকর্ড ডেটের আগের দিন শেয়ার কিনলে তিন দিন পরে গিয়ে ডিভিডেন্ট পেয়ে যাবেন, এটা তো সারা বছরের জন্য হয় না। তাড়াতাড়ি এই কথাটা এখান থেকে বাদ দিতে হবে। বিনিয়োগ মানেই হচ্ছে একটা সময়ের জন্য বিনিয়োগ হতে পারে- এটা ৬ মাস, ৯ মাস, ১ বছর কিংবা ৫ বছর।

৭. সঠিক সময়ে শেয়ার কেনাবেচা না করা

সঠিক সময়ে শেয়ার না কেনাও লসের একটা কারণ। সঠিক সময় বলতে সাধারণ বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনার দেখা উচিত গত ছয় মাস বা এক বছরে শেয়ারের প্রাইসটা কোথায় ছিল। অনেক ওয়েবসাইট আছে যেখানে শেয়ারের এক বছর দুই বছরের তথ্য থাকে। যদি আপনি দেখেন যে শেয়ারের প্রাইসটা পিক-এ আছে, অতীতে এত টাকার উপরে এই শেয়ারের দামটা ওঠেনি, আবার উঠলেও পড়ে গেছে এগুলোকে আমরা পিক বলি। ওই পিকে শেয়ার না কেনাই ভালো। এখন যিনি শুনে কেনেন, উনি তো কোনো ওয়েবসাইটে যান না, কোনো এনালাইসিসও করেন না। এটা জটিল কিছু না। এটা সাধারণ মানুষকে বললেও বুঝতে পারবে- এই শেয়ারটা গত দুই বছরে একবার ১৮ টাকা উঠে পড়েছে, আরেকবার সাড়ে ১৮ টাকা উঠে আবার পড়েছে, তো আপনি সেই শেয়ারটাই পরে যদি ২৩-২৪ টাকা হয়, তো আপনি সেটা কিনবেন না।

নতুন বিনিয়োগকারীদের এটাই বলব যে অতীতের দামের রেকর্ডটা একটু দেখবেন। যদি কোনো কোম্পানির ইপিএস খারাপ আসে, আর সাথে সাথে শেয়ার বিক্রি করে দেন, তাহলে এটা ভালো সিদ্ধান্ত হবে না।

এখন বিনিয়োগকারীদের উচিত ধৈর্য ধরে শেয়ার কেনা এবং অপেক্ষা করা। ওভারনাইট আপনি লাভ চাইলে এটা পারবেন না।

যখনই কোনো একটা শেয়ারে ভুল বিনিয়োগ করলেন এবং দু-তিন দিন ধরে দাম পড়ছে, তাহলে যিনি শেয়ারটা বিক্রি করেছেন তিনি কিন্তু অসময়ের শেয়ারটা বিক্রি করে লাভের ভাগিদার হলেন। আর একটা কথা, ভালো শেয়ারের দাম যদি কমে তাহলে এটা বাড়ার সম্ভাবনাও থাকে।

আমি বারবার করে বলছি, পুঁজিবাজার এমন একটা জয়গা যেখানে প্রচুর পড়াশোনা করা লাগে।

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড।

সংবাদটি শেয়ার করুন

পুঁজিবাজার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :