ড. ইউনূসের কর ফাঁকি

মো. সাখাওয়াত হোসেন
| আপডেট : ০৮ জুন ২০২৩, ০৯:৫৬ | প্রকাশিত : ০৮ জুন ২০২৩, ০৮:৩২

১২ কোটি টাকা কর দাবি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের করা তিনটি আয়কর রেফারেন্স মামলা খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে ড. ইউনূসকে এনবিআরকে ১২ কোটি টাকা পরিশোধ করতেই হবে। এখানে ব্যাপারটি হচ্ছে, ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি, বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি, বাংলাদেশের প্রথম নোবেল প্রাপ্ত ব্যক্তি। কাজেই ড. ইউনূসকে নিয়ে এ ধরনের নেতিবাচক খবর আমাদেরকে আশাহত করে, বিভ্রান্ত করে, আমাদেরকে প্রকারান্তরে থামিয়ে দেয়। তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছে প্রফেসর ইউনূস অনুসরণীয় হতে পারতেন, একটি নির্দিষ্ট বয়সের অনেকেই ড. ইউনূসকে অনুসরণ করে এবং সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। এ জায়গায় ড. ইউনূসকে নিয়ে এ ধরনের একটি সংবাদ পিলে চমকে উঠার মতই।

তিনি যেখানে রাষ্ট্রকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা করবেন, বাংলাদেশের দূত হয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে প্রিয় স্বদেশকে ব্র্যান্ডিং করবেন; সে জায়গায় ড. ইউনূসের কর ফাঁকির অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার ঘটনায় আমরা যারপরানই হতাশ ও বিমর্ষ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আহূত মামলায় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। ড. ইউনূসের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান। শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেলে এ এম আমিন উদ্দিন জানান, তিনি (ড. ইউনূস) বলেছেন, টাকা দান করেছেন। তাই কর অব্যাহতি পাবেন। আর আমরা বলেছি, কর অব্যাহতির যেসব কারণ উল্লেখ করা আছে, সেগুলোর মধ্যে ড. ইউনূসেরটা পড়ে না। এজন্য তাকে দানকর দিতে হবে। বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার ও বিচারপতি রাশেদ জাহাঙ্গীরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

মামলায় প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সালের দানকর আইন অনুযায়ী ২০১১-২০১২ করবর্ষে মোট ৬১ কোটি ৫৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা দানের বিপরীতে প্রায় ১২ কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকা কর দাবি করে নোটিশ পাঠায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০১২-২০১৩ করবর্ষে ৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা দানের বিপরীতে এক কোটি ৬০ লাখ ২১ হাজার টাকা দানকর দাবি করা হয়।আর ২০১৩-২০১৪ করবর্ষে ৭ কোটি ৬৫ হাজার টাকা দানের বিপরীতে এক কোটি ৫০ লাখ ২১ হাজার টাকা কর দাবি করে নোটিশ দেয় এনবিআর।দানের বিপরীতে কর দাবি করে এনবিআরের এইসব নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ড. ইউনূস। তাঁর দাবি, আইন অনুযায়ী দানের বিপরীতে এনবিআর এই কর দাবি করতে পারে না। এরপর ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর তার আবেদন খারিজ করেন। এরপর ২০১৫ সালে তিনি হাইকোর্টে তিনটি আয়কর রেফারেন্স মামলা করেন।ওই মামলাগুলোর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে দানকর দাবির নোটিশের কার্যকারিতা স্থগিত করে ২০১৫ সালে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

আমরা প্রত্যেকেই জানি, রাষ্ট্রের ব্যয়ভার নির্বাহ হয় জনগণের ট্যাক্স ভ্যাটের টাকায়। এ বিষয়টি অর্থনীতিববিদদের নিকট খুব সহজেই অনুমেয়। জাতীয় রাজস্ব সপ্তাহ পালন করে এনবিআর, জনসাধারণকে কর প্রদানে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে। অঞ্চলভিত্তিক সেরা করদাতার পুরস্কার প্রদান করা হয়। অর্থাৎ জনসাধারণকে কর প্রদানে আকৃষ্ট করা এবং দেশের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা প্রদান করা হয়। সেখানে একজন অর্থনীতিবিদ হয়ে ড. ইউনূসের ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনাটি খুবই ভয়াবহ ও মারত্নক। কেননা এ ঘটনাটির প্রভাব কিন্তু তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি। এ ঘটনা থেকে অনেকেই ভুল বার্তা পেয়ে থাকতে পারে; একজন নোবেল বিজয়ী যদি ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারি তাহলে আমরা কেন নয়? এ মানসিকতা থেকে অনেকেই স্রোতে গা ভাসাতে পারেন।সঙ্গত কারণেই নেতিবাচক বিষয়ের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনার দৃশ্যপটে দেখা যায়, নেতিবাচক বিষয়ের ট্রেন্ড একবার তৈরি হলে সেটির রেশ সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দেখা গেল ইডেন কলেজের এক ছাত্রীর মূল সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলার পরবর্তী সময়ে অনেকেই এ কাজটি করছে এবং এসব খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ব্যাপকভাবে চাউর হচ্ছে। অর্থাৎ নেতিবাচক সংবাদগুলোর বিবরণ তীব্র গতিতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। একটি বিষয় হলফ করে বলা যায়, এ ঘটনার পরবর্তী সময়ে কাউকে যদি ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনার বিবরণে ড. ইউনূসের নাম চলে আসবে। এ ধরনের উদাহরণের বিবৃতিতে আমরা সচরাচর অভ্যস্ত হতে পারিনা।

যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল. প্রতিষ্ঠিত এবং যাদের সমাজে পরিচিতি রয়েছে তাদের ইতিবাচক কাজের যেমন বিস্তৃতি রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে নেতিবাচক কাজেরও ব্যাপকতা রয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি নেতিবাচক কাজগুলোকে নিয়েই আলোচনা সমালোচনা অধিক হয়ে থাকে। দেখা যাবে, সার্টিফিকেট পোড়ানোর ঘটনা মাঝে মধ্যে বিভিন্নভাবে দেশজুড়ে চলতে থাকবে কিন্তু অভিনব কোন কিছুর আবিষ্কারে তেমন আলোচনা হবে না। এ বিষয়টিকে ধরে নিয়েই সামনের দিকে এগোতে হবে; মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মপরিধি প্রত্যেকটি জায়গায় এ ব্যাপারগুলো আলোচিত হয়।

দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রই দেশের সম্পদ। সীমিত সামর্থ দিয়ে হলেও দেশপ্রেমিকগণ দেশের কল্যাণার্থে, মঙ্গলার্থে কাজ করে থাকেন। আর যাদের সামর্থ রয়েছে, যাদের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে তারা তাদের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারেন। আবার যাদের কাজের মাধ্যমে দেশের বাইরেও পরিচিতি রয়েছে তারা যদি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক না হন তাহলে দেশের প্রতি তাদের মমত্ববোধ খুব একটা কাজ করে না। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে অনেকাংশে এ ধরনের চরিত্রের সংমিশ্রণ রয়েছে। তিনি ব্যাপক পরিচিত, দেশ এবং দেশের বাইরে অনেকেই তাকে সম্মানের সহিত মূল্যায়ণ করেন। কিন্তু দেশের ক্রান্তিকালিন সময়ে তার ভূমিকা তেমন দেখা যায় না। ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনাটি সকলকিছুর সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১/১১ এর সময়ে ড. ইউনূসের ভূমিকা অনেকেরই জানা রয়েছে। দেশের সঙ্কটে কোন ভূমিকাতেই ড. ইউনূসকে প্রত্যক্ষভাবে সন্মুখ সারিতে দেখা যায় না। সময় একদিন সবকিছুর পেছনের ঘটনাকে তুলে ধরবে।

তবে আমরা মনে করি, যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের টাকায় সরকার পরিচালিত হয় সেহেতু সরকারকে সহযোগিতা করা জনগণের ঐকান্তিক দায়িত্ব। কর-ভ্যাট নিয়মিত হারে পরিশোধ করাও জনগণের নৈতিক দায়িত্ব। কথায় আছে; নামে নয় কাজে পরিচয়। নামে বড় হলেই যে দেশপ্রেমিক হবে এটাও যেমন সঠিক নয় আবার কাজের মাধ্যমে পরিচয়হীন অনেকেই বড় হয়ে উঠেন। তবে যাদের নামের পরিচিতি আছে তারা যদি কাজে কর্মে আচরণে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেন তাহলে তাদের কাজের মাধ্যমেই অনেকেই অনুপ্রেরণার উৎস খুঁজে নিয়ে নিজেকে তৈরি করার ক্ষেত্রে উপযোজক হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন। সে কারণেই নামী মানুষদের আচরণে খুঁটিনাটি বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক সাজেশন্স ও চিহ্নিত সমস্যার সমাধানে অনেকেই অনুপ্রাণিত হতে পারেন।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :