স্বাস্থ্যের পরীক্ষায় জালিয়াতি: নিয়োগ কমিটির সভাপতিসহ চারজনের নামে দুদকের মামলা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে নিয়োগ কমিটির সভাপতিসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কমিশনের উপপরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মঙ্গলবার এ মামলা করেন।
মামলায় আসামিরা হলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম, উপপরিচালক প্রশাসন ডা. আ ফ ম আখতার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শাওকাত আলী ও খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ।
আসামিদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধি ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪৭৭(ক) ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে খাতা প্রনয়ণ ও খাঁটি হিসেবে ব্যবহার এবং অপরাধমূলক অসদাচরণ করে অফিসিয়ালি সরবরাহকৃত উত্তরপত্র বর্তমানে থাকা উত্তরপত্র দ্বারা কোন এক পর্যায়ে প্রতিস্থাপিত করেছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এক হাজার ২০০টি, মেডিকেল টেকনেশিয়ান এক হাজার ৬৫০টি এবং ক্যার্ডিওগ্রাফারের ১৫০টি পদসহ মোট তিন হাজার পদ রাজস্বখাতে পদ সৃজন নবসৃজিত তিন হাজার পদের মধ্যে ২০২টি পদ বাদ দিয়ে দুই হাজার ৭৯৮টি শূন্য পদে জনবল নিয়োগের জন্য ২০২০ সালের ২৩ জুলাই ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
ওই বছরের ৩০ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় তিনটি আলাদা আলাদা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ৫ জুলাই থেকে অনলাইন আবেদন শুরু হয় এবং ২০ জুলাই শেষ হয়। মোট ৭২ হাজার ৬১৫ জন প্রার্থী আবেদন করেন। আবেদনকারী ২৩ হাজার ৫২২ জনের অনুকূলে অনলাইনে টেলিটকের মাধ্যমে প্রবেশপত্র ইস্যু করা হয়।
লিখিত পরিক্ষা গ্রহনের নিমিত্ত লিথোকোড সম্বলিত খাতা প্রনয়নের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গনিত বিভাগের চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শাওকাত আলী পরীক্ষার খাতা তৈরি (লিথোকোডসহ), কক্ষভিত্তিক খাতা প্যাকেট করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির কাছে পাঠান।
নিয়োগ কমিটি পরীক্ষা নেওয়ার আগের দিন রাতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে প্রশ্নপত্র প্রনয়ণ করেন। অতপর লিথোকড সম্বলিত খাতা, প্রশ্ন, হাজিরা শীট কেন্দ্র ভিত্তিক সিলগালা করে ট্রাঙ্গে রেখে তালা সিলগালা করেন। পরীক্ষার দিন সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনোনীত কেন্দ্র ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিলগালাকৃত ট্রাঙ্ক বুঝে নিয়ে বাহন মারফত কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছে বুঝে দেন।
২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কেন্দ্র থেকে খাতা, লিথোকডের ছেঁড়া অংশ এবং প্রশ্ন বুঝে নিয়ে বাহন মারফত অধিদপ্তরে নিয়ে আসেন। নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব উপপরিচালক আ ফ ম আক্তার হোসেনের কাছে জমা দেন।
তিনি সব খাতা বুঝে নিয়ে একই দিন মেডিক্যাল টেকনোলজিষ্ট ও মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান (ইসিজি) সংশিষ্ট খাতা মূল্যায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গনিত বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শাওকত আলীর কাছে দেন। আর মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান (অন্যান্য) পদের লিখিত খাতা মূল্যায়নের জন্য খিলগাও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদের কাছে দেন।
লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রাতে কিছু সন্ডিকেট চক্র আবারও নতুন খাতায় প্রশ্ন উত্তর লিখে মো. হারুনুর রশিদ ও মো. শাওকত আলীর সহোযোগিতায় অফিসিয়ালি সরবরাহকৃত কিছু কিছু উত্তরপত্র বর্তমানে থাকা উত্তরপত্র দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন।
টেকনেশিয়ান ও টেকনোলজিস্ট পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চার হাজার ৪৫৩টি খাতা, টেবুলেশন শীট ও অন্যান্য ডকুমেন্টস পরীক্ষান্তে দুই হাজার ৪১১টি উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিংয়ের ছিদ্র ও পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন প্রকারের সংকেত লক্ষ্য করা গিয়েছে। এছাড়া চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ দুই হাজার ৫৫৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ জন পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিংয়ের ছিদ্র ও পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন প্রকারের সংকেত লক্ষ্য করা গিয়েছে।
দুই হাজার ৪১১টি উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিংয়ের ছিদ্র ও পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন প্রকারের সংকেত সংক্রান্তে চাকরিপ্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা কোন সঠিক তথ্য দেননি।
তবে গোপনীয় অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত বিভিন্ন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজসে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার শর্তে জালজালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়।
(ঢাকাটাইমস/২০জুন/এএ/ডিএম)