সহিংসতা নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ০২ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩৩

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে এই সরকারের অধীনে সংসদীয় আসনে বেশ কিছু উপ-নির্বাচন হয়েছে এবং স্থানীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনগুলোতে প্রত্যাশার চেয়ে কম সংখ্যক ভোটার ভোট প্রদানে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়। এ নিয়ে দেশের অনেকেই বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে যার যার মত করে মন্তব্য দিয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু ভোট প্রদান করতে গেলে মানুষের মধ্যে যে ভয়ের শঙ্কা কাজ করে সে বিষয়টি তুলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে কৃপণতা দেখা যায়। অর্থাৎ একটি পক্ষ রয়েছে যারা জনগণকে ভোট প্রদানে নিবৃত্ত করার তাগিদে মিথ্যা প্রোপাগন্ডা ছড়িয়ে জনগণকে নানাভাবে হেনস্তা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাস্তবিক অর্থে, সরকার আর নির্বাচন কমিশনের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পালনে এক পক্ষ বরাবরই সোচ্চার। কিন্তু প্রকৃত বিষয়াদি আলোচনার সাপেক্ষে সত্য মিথ্যার মিশেলে কথা বলা বাঞ্জনীয়।

সরকারের সব থেকে বড় অস্ত্র হচ্ছে, নিমিষেই দেশের যে কোন প্রান্তের খবরাখবর মূহুর্তের মধ্যে সংগ্রহ করতে পারে। সরকারের ইন্টিলিজেন্সি উইং প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা দেখিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ইন্টিলিজেন্সি উইং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কাজেই, নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে সরকারের নিকট এ সংক্রান্তে তথ্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের দুটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ পাশাপাশি ঢাকা শহরে আয়োজন হয়েছে, এটি রাজনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। বিদেশী বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিষয়টি আবার এ দেশের যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবেন, রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন তারাও বেশ সাধুবাদ জানিয়েছে ব্যাপারটিতে। কিন্তু পরিস্থিতির পরবর্তীতে কি হল, দেখা গেল ঈগল পরিবহনের বাসে হামলা হয়েছে, হামলার শিকার হয়ে পুলিশ সদস্যরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। এখন যদি সরকার ঘোষণা দিয়ে বলে, রাজনৈতিক কর্মসূচির অনুমতি প্রদান করলে কতিপয় রাজনৈতিক দলের সদস্যরা পুলিশের উপর চড়াও হয়, তাহলে সেখানে সঙ্গত কারণেই সরকার মিছিল সমাবেশের অনুমতি প্রদান করবে না।

বিগত সময়ে সরকার সমাবেশ আয়োজনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাবিধ শর্ত আরোপ করে দিয়েছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে সমাবেশ আয়োজনে বিরত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে। সরকারের সে সব সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে অনেকেই, এখন সরকার যদি বলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই তারা সমাবেশ আয়োজনের বিরোধিতা করেছে। এই যে বাসে হামলার ঘটনা, বিচ্ছিন্নভাবে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা এসব কিসের আলামত? সন্দেহাতীতভাবে পরিচ্ছন্ন রাজনীতির আলামত নয়। এ বিষয়সমূহ কিন্তু বেশ কিছু ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। প্রথমত: আসন্ন নির্বাচনে এ গ্রুপটি আরও বড় ধরনের ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে, যে বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির আবির্ভাব ঘটাবে। এ ভয় থেকেই কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা নির্বাচনে ভোট প্রদানে বিরত থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহ প্রদান করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোট দিয়ে মতামত জানানোর পরিবেশ পরিস্থিতি কতজনের মধ্যে আছে সেটিও বিবেচনার বিষয়। দ্বিতীয়ত: এ ধরনের সহিংস আচরণের কারণে মূলত একটি বার্তাই সুস্পষ্ট হয় যে; একটি পক্ষই রয়েছে যারা নির্বাচনকে বানচালের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। তারা কখনোই চায় না, এ দেশে সুস্থ সাবলীল ভাবে নির্বাচন পরিচালিত হউক; তারা একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্রেক করে বিদেশী প্রভুদের সহায়তা নিয়ে সাধারণ জনগণের ভোটের সমর্থন ব্যতিরেকে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের ঘরে উঠিয়ে নিবে। তৃতীয়ত: চক্রটি দেখাতে যাচ্ছে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম নয়, তাই তারা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে অস্থিতিশীল বাংলাদেশের চিত্র উপস্থাপন করে তৃতীয় পক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাচ্ছে। চতুর্থত: আসন্ন নির্বাচনে মানুষ যাতে ভোট দিতে নিরুৎসাহ বোধ করেন সে বিবেচনায় তারা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে ভোটের প্রতি এক ধরনের অনিহা সৃষ্টির অবতারণা থেকে বাসে ভাংচুর ও পুলিশকে টার্গেট করে হামলার সূচনা করেছে।

স্বাভাবিকভাবে একটি রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনের বিরোধিতা করে নির্বাচনের পরিবেশকে বিনষ্ট করতে চায়, উঠেপড়ে লেগে যায়, তাহলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে দোষারোপ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণ রাজনৈতিক দলের দেশব্যাপী সমর্থক থাকে সেটি কম কিংবা বেশি হউক; তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কিংবা উৎসাহে অনেকেই নির্বাচনকে বানচাল করার তাগিদে ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার আগ্রহ পাচ্ছেন। আবার এ দিকে, নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন সময়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে দলগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত গ্রহণ করে থাকে। নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে, বিশেষ করে নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, নির্বাচনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে, ভোটারদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কিভাব নিশ্চিত করা যায়, প্রার্থীদের নিরাপত্তা কিভাবে সুনিশ্চিত করা যায় প্রভূত বিষয়ে সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এ যাত্রায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। কাজেই কোন রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে-আহবানে সাড়া প্রদান না করে সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের তেমন দায় নেই। আপনি নির্বাচন কমিশনকে তখনি দায়ী করতে পারেন, যখন দেখবেন কমিশনের ক্ষমতাবলে প্রাপ্ত ক্ষমতায় আপনার সমর্থিত দলের যৌক্তিক ইচ্ছা/অনিচ্ছার বিষয়কে কমিশন গুরুত্বহীন মনে করছে। আপনি কমিশনকে অগ্রাহ্য করবেন আর সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলবেন বিষয়টি পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কাজেই এসব বিষয় বিবেচনায় গ্রহণ করেই রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে কমিশনকে সর্বাত্নক সহযোগিতা করা একান্ত কর্তব্য।

কাজেই রাজনীতির মাঠে আপনাকে সহনশীল আচরণ করতে হবে, নমনীয় হতে হবে। শুধু তাই নয়, নিয়মের মধ্যে কিভাবে ভাল নির্বাচন আয়োজন করা যায়; সে বিষয়ে আপনার ঐকান্তিক অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে থাকে। সাধারণ জনতা সহিংস আচরণকে সমর্থন করে না, আগুন-সন্ত্রাসের বিরোধিতাও করে থাকে জনগণ। সহিংসতার পথ অবলম্বন করে রাজনীতিতে স্থিতি অর্জন করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতার কোন জায়গা নাই। তাছাড়া সহিংসতা পরিচ্ছন্ন রাজনীতির পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। বাংলাদেশের মানুষও সহিংস রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে। সে কারণেই নির্বাচনের প্রাক্কালে গাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে, গাড়ি ভাংচুর করে, পুলিশের উপর আঘাত করে, মানুষকে ভয় ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করার দিবা স্বপ্ন দুঃস্বপ্নেই পরিগণিত হবে।

লেখক-চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :