একটি ব্যাংককে পথে বসাতে খেলাপি ঋণই যথেষ্ট: মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ

মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩, ১৭:০২ | প্রকাশিত : ২০ আগস্ট ২০২৩, ১১:২৪

একটি ব্যাংকের জন্য খেলাপি ঋণ সব দিক দিয়েই খারাপ। খেলাপি ঋণ একটি ব্যাংককে পথে বসিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কোনোভাবেই এই খেলাপী ঋণ বাড়তে দেওয়া যাবে না।

ঢাকা টাইমসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এমনটাই বলছেন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্‌ উদ্দীন আহমেদ। সাক্ষাতকারে তিনি বর্তমানে বেসরকারি এই ব্যাংকটির নানা বিষয় ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়েও কথা বলেন।

মোসলেহ্‌ উদ্দীন আহমেদ শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি হওয়ার আগে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক লিমিটেড ও এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১৩ সালে যমুনা ব্যাংকে যোগ দেন মোসলেহ্‌ উদ্দীন। পরে যমুনা ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব বিজনেস হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মোসলেহ্‌ উদ্দীন দি সিটি ব্যাংকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কর্পোরেট ডিভিশন ঢাকা অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গুলশান শাখার প্রধান, পরবর্তীতে রিজিওনাল হেড অব ক্রেডিট এবং প্রাইম ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে লিজিং ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রশ্ন: শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কত বছর হয়েছে?

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২৩ বছরে পর্দাপন করেছে।

প্রশ্ন: প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের পরিবর্তে আপনারা জোর দিয়ে আসছেন ব্যক্তি আমানতে। এর ফলে মুনাফা আর আর্থিক সূচকে ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা কেমন?

আমরা ব্যাক্তি আমানতে বেশী জোর দিচ্ছি। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতগুলো হঠ্যাৎ আসে আবার হঠ্যাৎ চলে যায়। তাই যেকোনো ব্যাংকের আমানতের শক্ত ভিত্তি ব্যাক্তি আমানতের মধ্যেই হয়। ব্যাক্তি আমানত খুব রাতারাতি বৃদ্ধিও হয় না আবার রাতারাতি চলেও যায় না। এ কারণে ব্যাক্তি আমানত যে ব্যাংকে বেশী আছে তার ভিত্তি তত ভালো থাকে।

প্রশ্ন: বর্তমানে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ব্যাক্তি আমানত কত আছে?

বর্তমানে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ৫ হাজার কোটি টাকা সারপ্লাস ব্যাক্তি আমানত আছে।

প্রশ্ন: প্রাতিষ্ঠানিক বড় বিনিয়োগ না কি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অর্থায়ন, কোন দিকটাতে বেশি গুরুত্ব দেন?

আমরা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বেশি গুরুত্ব দেই।

প্রশ্ন: ২০২২-২৩ অর্থবছরে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক কত টাকা আমাদনি-রপ্তানি করেছে?

২০২২-২৩ অর্থবছরে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানি হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা, আর আমদানি হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।

প্রশ্ন: ডলার সংকট মোকাবিলায় বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে আপনারা কি ধরনের ভূমিকা নিয়েছেন?

ডলারের ক্রাইসিসের মধ্যেও আমরা কোনো ঝামেলায় পরিনি। আমরা আমাদের রেগুলার গ্রাহকদের এলসি খুলতে কোনো সমস্যায় পরিনি। কেননা আমদানি-রপ্তানির হিসেবে আমরা লাভবান। যথেষ্ট পরিমাণ ডলারও ছিলো।

প্রশ্ন: রেমিট্যান্স আসে কি রকম?

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের আমাদের ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মত রেমিট্যান্স এসেছে। এছাড়া আমরা রেমিট্যান্স বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩০ টি এজেন্সীর সাথে নতুন করে চুক্তি করেছি। এছাড়া আমাদের প্রতিটি ব্রাঞ্চে আলাদা রেমিট্যান্স ডেস্ক খুলেছি।

প্রশ্ন: বর্তমানে শাহজালাল ব্যাংকের আমানত, ঋণ আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত?

শাহজালাল ব্যাংকে বর্তমানে আমানত আছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। আর ঋণ দেওয়া আছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। আমাদের মোট ঋণের ৪ শতাংশ খেলাপী ঋণ। এর মধ্যে কিছুটা ফেরত আসবে বলে মনে করি। আমরা কাজ করছি। এই ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে জামানত বাবদ যা দিয়েছে সেগুলো নিয়ে রিসার্চ করছি।

প্রশ্ন: খেলাপী ঋণ আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর?

এই টাকাগুলো ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা। এই টাকাগুলো আমি দিলাম কিন্তু ফেরত আসলো না, কিন্তু ডিপোজিটরদের টাকাটা ফেরত দিতে হবে। যখন এটা বেশি হয়ে যাবে তখনতো এটা ফেরত দিতে পারবো না। তখনতো তারা আমাদের বিশ্বাস করবে না। এই খেলাপী ঋণের কারনে ব্যাংকের ওপর মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেলে ব্যাংকেরইতো অস্তিত্ব থাকবে না। এছাড়া আমি এলসি খুললাম, সেই টাকাতো আমার পেমেন্ট করতে হবে। এখন আমার কাছে ডলারও নাই টাকাও নাই, কিভাবে কি করবো।

এছাড়া ব্যাংকের ইনকাম কমে যাবে। কেননা আমরাতো আয় করি ঋণ থেকে। আর আয় না থাকলে ডিপোজিটরেদের লভ্যাংশ দেবো কোথা থেকে। সব মিলিয়ে বলবো খেলাপী ঋণ সব দিক দিয়েই খারাপ। খেলাপী ঋণ একটি ব্যাংককে পথে বসিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কোনোভাবেই এই খেলাপী ঋণ বাড়তে দেওয়া যাবে না।

প্রশ্ন: এই খেলাপী ঋণের জন্য কাকে দায়ী মনে করেন?

এর জন্য আমি শুধুমাত্র খারাপ গ্রাহকদের দায়ী করবো না, এক্ষেত্রে আমাদের কর্মকর্তাদেরও দোষ আছে। আমরা দেখছি একটি কাস্টমার অনেক ব্যাংক লোন দিচ্ছে। তবে অনেক সময় আমাদের এই কাস্টমারকে যখন লোন দিচ্ছি তখন এই কাস্টমারের সময় খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু সেটা জেনে শুনে বুঝে ঋন দেওয়া যাবে না। আমি সব ব্যাংকের উদ্দেশে বলবো, ঋণ দেওয়ার আগে সব খোঁজ খবর নিয়ে, কাগজপত্র যাচাই-বাচাই করে ঋণ দিতে।

প্রশ্ন: ব্যক্তি গ্রাহকদের জন্য আপনাদের প্রডাক্টগুলো সম্পর্কে বলেন। একজন গ্রাহক কেন আপনাদের পছন্দ করবে, এমন কোনো সেবা নিয়ে যদি বলেন।

ব্যাংকিং ইন্ড্রাষ্টিতে এমন কোনো সুবিধা নেই, যা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে নেই। স্পেশাল বলতে, ধরেন আমাদের অ্যাপস আছে, যেটা দিয়ে টাকা উঠানো-পাঠানো সবই করা যায়, ইউটিলিটি বিল দেওয়া যায়। আমাদের সারাদেশে ১১৩ টি এজেন্ট ব্যাংকি আছে, যেখান থেকে গ্রাহকরা সেবা নিতে পারেন। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন সবই আছে।

আমাদের স্পেশাল একটি প্রোডাক্ট আছে নাম সুরক্ষা, ডিপোজিটের ওপর ভিত্তি করে প্রতিদিন মুনাফা দেওয়া হয়। এছাড়া কেউ যদি ঋণ নিয়ে মারা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ মওকুফের নিয়ম অনুযায়ী আমরা সেটাও করি।

প্রশ্ন: আপনাদের কত শাখা, কত কর্মী আছে?

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বর্তমানে ১৪০টি শাখা আছে, ৪টি উপশাখা, ১২০টি এটিএম আছে।

প্রশ্ন: কর্মী সংখ্যা কতজন?

আমাদের কর্মী সংখ্যা ২৪ হাজারের মত। আমরা ইনসেটিব ভোনাস হিসেবে ব্যাংকের প্রফিট কর্মীদের মধ্যে শেয়ার করি।

প্রশ্ন: ২০২২-২৩ অর্থবছরে কত টাকা মুনাফা হয়েছে?

আমরা পরিচালনগত মুনাফা করেছি ৯০০ কোটি টাকা। সব খরচ শেষে ৪০০ কোটি টাকা প্রফিট করেছে।

প্রশ্ন: বর্তমান দেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং সেক্টরটা কিভাবে চলা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে সব শহুরে ব্যাংকিং। শহরগুলোতে বিল্ডিংয়ে বিল্ডিংয়ে ব্যাংক পাবেন, উপজেলাগুলোতে গেলেই দেখবেন অনেক কমে গেছে। ইউনিয়ন পর্যায়েই দেখবেন ব্যাংক নাই বললেই চলে, আরে গ্রামে গেলে দেখবেন নাই। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। আমাদের এই ব্যাংকিং খাতকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। দেখা গেলো গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা কাজ করছে, তারা কিন্তু তেমন একটা নিয়ম নীতির আওতায় না। গ্রামে ব্যাংকিং সেবাটা হাতের মুঠোই নিয়ে আসতে হবে।

এখনো বলা হয়, আমাদের ৫০ শতাংশ জনগণ ব্যাংক সেবার বাইরে, তাই এ সেবা গ্রামেগঞ্জে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঋণ দিলে কিন্তু রিস্কও কম থাকে। খেলাপী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

প্রশ্ন: বর্তমানে দেশের ব্যাংকি সেক্টর কি অবস্থায় আছে?

আমার মনে হয় ব্যাংকিং সেক্টর একটু চাপের মধ্যে আছে। ঋণ খেলাপী বাড়ছে, যেহেতু বিশ্বব্যাপী একটি মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে, সে কারণে এ সেক্টর একটু ঝুঁকির মধ্যে আছে। এখন আমাদের ব্যাংকারদের সজাগ হয়ে কাজ করতে হবে এবং ডিপোজিটরদের আমানত সুরক্ষার জন্য সবই করতে হবে।

ঢাকা টাইমস: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সাক্ষাৎকার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

সাক্ষাৎকার এর সর্বশেষ

সচেতনতার শক্তি পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশ গড়তে কাজ করে যাচ্ছেন প্রকৌশলীরা: এস. এম. মঞ্জুরুল হক 

‘স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে সরকারকে ভারসাম্যমূলক নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে’: ড. আতিউর রহমান

প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আর্মিরা ধরে নিয়ে যাবে: ফরিদা খানম সাকি

দাম বাড়ালে এতক্ষণে কার্যকর হয়ে যেত: ক্যাব সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন

জন্ম থেকেই নারীদের যুদ্ধ শুরু হয়: নারী উদ্যোক্তা ফরিদা আশা

নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই

ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম করা উচিত: কাউন্সিলর আবুল বাশার

তদারকি সংস্থা এবং ভবন নির্মাতাদের দায়িত্বশীল হতে হবে: অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান

বেইলি রোডের আগুনে রাজউকের ঘাটতি রয়েছে: মো. আশরাফুল ইসলাম

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :