পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর টুইট ও রাজনীতি

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সম্প্রতি করা একটি টুইটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্কিন দুই কূটনীতিক উইলিয়াম মিলাম এবং জন ড্যানিলোভিজদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা এই দুই কূটনীতিক নিরপেক্ষ নন বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। টুইটে শাহরিয়ার আলম বলেন, সবাইকে অবশ্যই জানা উচিত যে এই সাবেক কূটনীতিকরা নিরপেক্ষ নন। তারা কখনই নিরপেক্ষ ছিলেন না, এমনকি যখন তারা ঢাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রশ্ন হলো তারা কি বিনা পয়সায় এটা করছেন? যদি না হয়, তাহলে কারা তাদের বেতন দিচ্ছেন? আমরা এই কেন’র উত্তর জানি।
এই টুইটের পরেই নেট দুনিয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। আপনারা যদি খেয়াল করে থাকেন তাহলে দেখবেন অনেক দেশের কূটনীতিকই বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করে থাকেন, কূটনৈতিকগণ তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে থাকেন কিন্তু আমেরিকার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। তাদের কথা বলতেই হবে, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে তাদের মনোভাব বরাবরের মতোই লক্ষ্যণীয়। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে তাদের মধ্যে দৃষ্টতা দেখা যায়। কূটনীতিকদের ভাষ্য হতে হবে কূটনীতির নিয়মকানুন অনুযায়ী। সে জায়গায় কূটনীতির পথপরিক্রমা পার হয়ে একজন কূটনীতিক যখন রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সেখানেই প্রশ্নের উদ্ভব হয়। বিশেষ করে সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে আসেন তখন বোঝা যায়, বাংলাদেশের কাছে আমেরিকার কী প্রত্যাশা ছিল? অর্থাৎ এর পিছনে কোনো না কোনো কারণ রয়েছে, না হলে অতিমাত্রায় প্রভাব রাখার লক্ষ্যে রাজনীতিবিদের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো মানে হতে পারে না।
শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে মুঠোয় না রাখতে পারলে মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের জোর করে কিংবা বাধ্য করে প্রার্থিত বিষয় আদায়ের প্ররোচণা পরিলক্ষিত হচ্ছে যার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে ভিসানীতি ইস্যু, র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি। সুতরাং জনাব আলমের যে অভিযোগ সেটির ব্যাপারে বেশ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা যেতেই পারে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের আলোচনা বিশেষ মাত্রা যোগ করবে।
সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে জানা যায়, একজন বাংলাদেশি কূটনীতিক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই টুইটটি রিটুইট করে লিখেছেন, ‘পশ্চিমা সমাজে কোনো কিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না! মজুরি ঘণ্টাভিত্তিক পরিষেবার ভিত্তিতে!’ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই টুইটের জবাবে জন ড্যানিলোভিজ বলেছেন, ‘মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জানেন যে এটি একটি মিথ্যা এবং এটি দুঃখজনক যে তিনি চরিত্র হননের সঙ্গে জড়িত। আমি বুঝতে পারি এবং দুঃখ প্রকাশ করছি যে তিনি এই ধরনের একটি মৌলিক বিষয় বেছে নিয়েছেন, যার জন্য তাকে কতটা চাপের মধ্যে থাকতে হবে। বাংলাদেশ এবং এর নাগরিকদের প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা আছে। আমি সেখানে এবং সর্বত্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উন্নয়নে আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই।’
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, শাহরিয়ার আলমের টুইট করা ভিডিও স্টোরিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারি মুশফিকুল ফজল আনসারির সঙ্গে সাবেক কূটনীতিকদের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। উইলিয়াম মিলাম ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে এবং দক্ষিণ এশিয়া প্রেক্ষিত ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জন ড্যানিলোভিজ ২০০৭ সাল এবং ২০০৮ সালে সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে ২ বার ঢাকায় রাষ্ট্রদূত ও ম্যাগাজিনটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘বিএনপির অর্থায়নে’ নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটি পরিচালনা করেন মুশফিকুল ফজল আনসারি। আনসারি একটি নিউজ পোর্টাল জাস্টনিউজের সম্পাদকও। তাকে প্রায়শই ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে দেখা যায় এবং এই প্রশ্নগুলোকে বিএনপির পক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্ন হিসেবেও দেখা হয়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভিডিও স্টোরিতে প্রশ্ন করা হয়, ‘কীভাবে মার্কিন কূটনীতিকরা এমন একটি দলের পক্ষে ওকালতি করতে পারেন, যেটি এখন পলাতক ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ইতোমধ্যেই হিংসাত্মক রাজনীতির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত এবং মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে? জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং ব্যাপক দুর্নীতিতে লিপ্ত।’ ভিডিওতে উইকিলিকসের পুরনো প্রতিবেদনগুলোও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে তারেক রহমান সম্পর্কে মার্কিন কূটনীতিকের যোগাযোগ ফাঁস হয়েছিল।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে এসে অভিযোগ তুলেছেন তার স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এখন জনাব আলমের অভিযোগ অসত্য এটি প্রমাণের দায় মার্কিন সাবেক দুই কূটনীতিকের। বাংলাদেশের একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে মার্কিন দপ্তরের কারও যোগাযোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করা কেউ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। তাছাড়া একটি পক্ষকে সামনে নিয়ে এসে সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করবার অপচেষ্টাও গ্রহণীয় নয়। কূটনীতিকগণ বাংলাদেশ সরকারের অতিথিসম। নিরপেক্ষ জায়গা থেকে কূটনীতিকরা দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করবেন, এমনই স্বাভাবিক নিয়মে হয়ে থাকে। কিন্তু আমেরিকার কূটনীতিকদের চরিত্রে এ সমীকরণের ব্যত্যয় দেখা যায়।
বাংলাদেশে অসংখ্য দেশের কূটনীতিক তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন-সে জায়গায় সাবেক দু’জন কূটনীতিকের ব্যাপারে জনাব আলমের টুইট বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, উল্লেখিত দু’জন কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনের সময় এমন অভিযোগ তোলেন নি কেন? ভিয়েনা কনভেনশন মোতাবেক গ্রহিতা রাষ্ট্র যদি কোনো কূটনীতিকের ব্যাপারে আপত্তি জানায় তাহলে প্রেরিত রাষ্ট্র উক্ত রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনার নজির নেই, সে জায়গা থেকে হয় তো বাংলাদেশ কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেনি। এমন সময়ে জনাব আলম টুইট করলেন যখন আমেরিকার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে আসে শতকরা ৭০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
কাজেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি বন্ধুদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে। রাজনীতি এ দেশের মানুষেরা করেন এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এ দেশের মানুষেরাই নেবেন। বিদেশিদের সঙ্গে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সম্পর্ক তৈরি হবে। সে জায়গাতে বিদেশিরা এ দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করবে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রাজনীতিবিদদেরও উচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশিদের ওপর নির্ভর না করে দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে রাজনীতির পথ পরিক্রমা নির্ধারণ করা। তাহলেই প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে দেশের ক্ষমতা ন্যস্ত হবে এবং দেশও উপকৃত হবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন