বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমাদের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ও পরস্পরবিরোধী

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৪২ | প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৪০

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে নানামুখী তৎপরতা চলছে। বিএনপি এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা জানাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, রাজনীতি ও কূটনীতি নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ।

প্রশ্ন: নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে রাজনীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে নানামুখী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?

হারুন-অর-রশিদ: বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি পরস্পরবিরোধী আদর্শিক ধারায় বিভক্ত। এর রূপটি হচ্ছে সাংঘর্ষিক। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে যে দ্বন্দ্বের ধারা আমরা দেখছি, এটি নতুন কিছু নয়। এর শুরু অনেক আগে। বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি ধারার সূত্রপাত ঘটে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী—বড় পরিসরে, এই দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে আমাদের রাজনীতি, সমাজ, এমনকি নাগরিক সমাজও। নির্বাচন এলে এই দুই ধারার পরস্পরবিরোধী অবস্থান আরো তীব্র হয়। এর কারণ হলো নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে। রাজনীতির এই দ্বান্দ্বিক রূপ নির্বাচন সামনে রেখে আরো ঘনীভূত হয়।

প্রশ্ন: পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা জানাচ্ছে। বিবৃতি দিচ্ছে। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের এত আগ্রহের কারণ কী বলে মনে করেন?

হারুন-অর-রশিদ: এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থা যেভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে এবং উৎসাহ দেখাচ্ছে কিংবা অন্যভাবে বললে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, এটি আগে এই মাত্রায় ছিল না। প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে পরাশক্তিগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করার যে উদ্যোগ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ তার মধ্যে পড়েছে। আসলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের যে রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি সাপোর্ট বেজ বা সমর্থক বলয় গড়ে তুলতে চায়, তার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে।

প্রশ্ন: অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে চাপ সৃষ্টির আড়ালে পশ্চিমাদের অন্য কোনো স্বার্থ আছে?

হারুন-অর-রশিদ: বাংলাদেশে যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে এটি তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। এর আড়ালে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। আর সেটি হলো বাংলাদেশকে তাদের বলয়ে রাখা। ভারত আমাদের তিন দিক থেকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খাঁটি। এ সম্পর্ক এত বিশাল ও ঐতিহাসিক যে এটি নিয়ে আর বিতর্কের সুযোগ নেই। এই সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। এর বাইরে চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সবাই চাচ্ছে বাংলাদেশ তাদের সমর্থন বলয়ের মধ্যে থাকুক। পশ্চিমারা চাইছে বাংলাদেশ কোনোভাবেই যেন চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে। পশ্চিমাদের এজেন্ডা হলো, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ, বিকাশমান বাজার। এখানে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। এখানে আরো বেশি করে আসার সুযোগ আছে। ফলে একে তাদের বলয়ে রাখতে চায় তারা।

প্রশ্ন: পশ্চিমা দেশগুলো তো এ দেশে মানবাধিকার, আইনের শাসন নিয়েও কথা বলে।

হারুন-অর-রশিদ: যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে। একদিকে তারা আইনের শাসনের কথা বলে। আবার যখন তাদের পছন্দের কারো ব্যাপারে আইনের প্রয়োগ করা হয় তখন তারা ক্ষুব্ধও হয়। যেমন, অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের বিচার। তিনি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি পেয়েছেন। এই বিচার নিয়েও যদি তারা কথা বলে তাহলে বুঝতে হবে, তারা এ দেশে আইনের শাসন, বিচারব্যবস্থাকে শ্রদ্ধা করে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন অস্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এর কারণ আইনের শাসন ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। বাংলাদেশে যদি কেউ আইন লঙ্ঘন করে, অসত্য প্রচার করে, তাহলে সে আইনের আওতায় আসবে—এটাই তো স্বাভাবিক। সেখানে বিচারের পর রায় নিয়ে যদি প্রশ্ন তুলে বিবৃতি দেয়, তাহলে এটি তাদের দ্বিমুখী ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান। আসলে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জবাবদিহি নেই। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। অনেক সময় তারা পরস্পরবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মূল বিষয় হলো শক্তি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ তাহলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের চাপে আছে?

হারুন-অর-রশিদ: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। আমাদের বিজয় তারা ঠেকাতে পারেনি। আমরা বিজয়ী হয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে এসেছিল। এ দেশের মানুষের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই এখানে জয়ী হবে। বিদেশি সব চাপ বাস্তবে কাজ করবে না। বিশ্বরাজনীতি, মেরুকরণের মধ্যেও বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয়—সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, এটা অনুসরণ করছে।

প্রশ্ন: আবার দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলি। বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে বলে মনে করেন?

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি যে শক্তিগুলোর বা দেশগুলোর ভরসা করছে, তারাও বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে পরামর্শ দেবে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা দেশের ভেতর ও বাইরে—দুই জায়গায়ই সৃষ্টি হয়েছে। সরকারেরও এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে ওই দেশগুলো হয়তো বলবে, নির্বাচনে যাও। আমরা তো পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করছি। এটি একটি বিষয়। অন্যটি হলো, নির্বাচনে না এসে বিএনপির টিকে থাকা খুব কঠিন। আমার মনে হয়, বিএনপি নির্বাচনে আসবে। এতে করে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। আর তারা যদি বর্জন করে, করতে পারে। কিন্তু নির্বাচন যদি প্রতিহত করতে হয় তখন তো নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি, ভোট কম হবে। দেখার বিষয় বিএনপি কোন অবস্থান নেয়। তবে এবার ২০১৪, ২০১৮-এর চেয়ে ভিন্ন একটা নির্বাচন হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচন কমিশন গত কয়েক মাসে যে নির্বাচনগুলো করেছে সেগুলো তো সুষ্ঠু হয়েছে। তারা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় সক্ষম। সেখানে আমরা নির্বাচনের দিকেই যাচ্ছি।

প্রশ্ন: বিএনপি অক্টোবরে চূড়ান্ত আন্দোলনের কথা বলছে।

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি আবার বলছে, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করবে। তারা তো দিনক্ষণ বেঁধে দিয়েছিল। ১০ ডিসেম্বর। সংসদ থেকে পদত্যাগ করল। চার বছর সংসদে থাকার পর পদত্যাগ করে আবার বলছে অবৈধ সংসদ। তাহলে তারা চার বছর থাকল কিভাবে? অন্যদিকে ছয়জন শপথ নিলেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিতে পারলেন না কেন? কারণ সিদ্ধান্ত লন্ডন থেকে আসে। যেখানে সিদ্ধান্ত লন্ডন থেকে আসে সেখানে তিনি প্রক্সি দেন। তাঁর তো নিজস্ব কোনো সত্তা নেই।

প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে? ছাড় দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

হারুন-অর-রশিদ: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিএনপিই বিতর্কিত করেছে। আমি মনে করি না আওয়ামী লীগের বিএনপিকে ছাড় দেওয়ার আর কোনো সুযোগ আছে। বিএনপি এরই মধ্যে এক দফার আন্দোলনে চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্বাচন কমিশন বাতিল—এটা কিভাবে তারা অর্জন করতে পারে? কোনো ক্ষমতাসীন দল স্বাভাবিকভাবে এটি করার কথা না। তারা সংবিধানের বিরুদ্ধে যাবে? বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও এটা করত না। দ্বিতীয়ত, বিএনপি ও অন্য দলগুলো এক দফার আন্দোলনে গিয়ে ইস্যুভিত্তিক আলোচনার সুযোগও শেষ করে দিয়েছে। এক দফার আন্দোলন না করে তারা যদি আলোচনার দরজা খোলা রাখত তাহলে নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও আরো অংশগ্রহণমূলক করা যায় সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারত।

প্রশ্ন: এই সুযোগে অন্য কোনো শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা কি আছে?

হারুন-অর-রশিদ: শীতল যুদ্ধ যখন ছিল তখন বিভিন্ন দেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটত। ২০১৪ সালে বিরোধী দল চেয়েছিল সেনা হস্তক্ষেপ ঘটুক। সেটি কিন্তু ঘটেনি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে কেউ যদি অবৈধ পন্থায় বা অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল বা তার ষড়যন্ত্র করে কিংবা তার সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা আছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করলে সেনাবাহিনী বা অসাংবিধানিক কোনো শক্তির ক্ষমতা দখলের চেষ্টা—এর সম্ভাবনা আমি আর দেখি না। তাহলে দাঁড়াল, নির্বাচনের দিকেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি। সংবিধান অনুযায়ী, বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে থাকবে। এই নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করবে।

প্রশ্ন: দলগুলোর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে বিদেশিরা অনেক সময় জানতে চান। ভবিষ্যতে বড় দুটি দলের নেতৃত্বে কারা আসতে পারে বলে আপনার ধারণা?

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে সংকটে পড়বে। আসলে এ বিষয়টি আরো দেখতে হবে। তবে রাজনৈতিক আদর্শ সংকট, নেতৃত্বসংকট—দুটিই বিএনপির এখনই আছে।

প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব?

হারুন-অর-রশিদ: প্রধানমন্ত্রী জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যাঁদের সঙ্গে নিয়ে গেছেন, সেলফি তুলেছেন, পাশে রেখেছেন। এটি মনে হয় ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

হারুন-অর-রশিদ: ধন্যবাদ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সাক্ষাৎকার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

সাক্ষাৎকার এর সর্বশেষ

‘স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে সরকারকে ভারসাম্যমূলক নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে’: ড. আতিউর রহমান

প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আর্মিরা ধরে নিয়ে যাবে: ফরিদা খানম সাকি

দাম বাড়ালে এতক্ষণে কার্যকর হয়ে যেত: ক্যাব সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন

জন্ম থেকেই নারীদের যুদ্ধ শুরু হয়: নারী উদ্যোক্তা ফরিদা আশা

নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই

ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম করা উচিত: কাউন্সিলর আবুল বাশার

তদারকি সংস্থা এবং ভবন নির্মাতাদের দায়িত্বশীল হতে হবে: অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান

বেইলি রোডের আগুনে রাজউকের ঘাটতি রয়েছে: মো. আশরাফুল ইসলাম

নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে ভবন অনুমোদন দিতে হবে: ইকবাল হাবিব

বীমা খাতে আস্থা ফেরাতে কাজ করছি: আইডিআরএ চেয়ারম্যান জয়নুল বারী

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :