সরকারের কত টাকা কর ফাঁকি দিল এনডিই চেয়ারম্যান ইমরান মুস্তাফিজ?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:০০ | প্রকাশিত : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:১৩

ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীতে জমি, ফ্ল্যাট বা ফ্লোরের মূল্য আকাশছোঁয়া হলেও সম্প্রতি জমিসহ একটি সাত তলা ভবন বিক্রির দলিলে দেখানো হয়েছে ‘পানির দর’। ওই এলাকায় ফ্ল্যাট নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে যে খরচ হয়-তার চেয়েও কম দাম দেখানো হয়েছে কেনাবেচায়।

বনানীর ১২ নম্বর সড়কের ই ব্লকের ১০৫ নম্বর বাড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে ঘটেছে এ পুকুর চুরি। বাড়িটির সব কটা ফ্লোর মিলিয়ে আয়তন ১৭ হাজার ৪৫৯ বর্গফুট। ক্রয়মূল্য দলিলে দেখানো হয়েছে মাত্র ৬ কোটি টাকা। যাতে জমির বাদ দিয়ে কেবল প্রতিটি ফ্লোরেরই প্রতি স্কয়ার ফিটের দাম পড়েছে ৩ হাজার ৪৩৬ টাকা।

আর সরকারি সর্বনিম্ন মূল্যে পাঁচ কাটা আয়তনের ওই জমির দাম আসে কাঠা প্রতি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাড়িটির জমির মূল্যই আসে অন্তত আড়াই কোটি টাকা। তবে বনানী এলাকায় সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্যে জমি বিক্রির নজির নেই বললেই চলে। কোটি টাকার নিচে এক কাঠাও মেলে না। সেই হিসাবে বনানীর ১২ নম্বর রোডের ওই বাড়ির জমিসহ সাত তলা ফ্লোরের কমপক্ষে দাম আসে ৪০ কোটি টাকা।

তবে কারসাজির মধ্য দিয়ে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইমরান মুস্তাফিজ বাড়িটি কিনেছেন মাত্র ৬ কোটি টাকায়। যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধান বলছে, বনানী ১২ নম্বর রোডে ফ্লোর বা ফ্ল্যাটভেদে প্রতি স্কয়ার ফিট বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকায়। সেই অনুযায়ী ৭ তলা বাড়িটির ১৭ হাজার ৪৫৯ বর্গফুটের দাম পড়ে ৩৬ কোটি টাকা।

তবে দলিলে ৬ কোটি টাকা কেনাবেচার মূল্য দেখিয়ে অন্তত ৩৪ কোটি টাকা প্রদর্শন করা হয়নি। আর এর মধ্য দিয়ে ৮ শতাংশ হারে উৎসে মূলে কর (ফ্ল্যাট ক্রয়কালের সরকারি রাজস্ব) ফাঁকি দেওয়া হয়েছে অন্তত ৩ কোটি টাকা। চলতি বছর কেনাবেচা হওয়া ওই বাড়িটির দলিল পর্যালোচনা করে এমন করফাঁকির চিত্রই উঠে এসেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, শুধু রাজধানী ঢাকা শহরের এ খাত থেকে গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজস্ব আদায় এক তৃতীয়াংশ কমেছে। এমন কর ফাঁকি ঠেকাতে না পারলে এ খাতের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি অর্থ বছরে জমি ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের ওপর ৮ শতাংশ উৎসে কর নির্ধারণ করে সরকার। যা গত জুলাই মাস থেকে কার্যকর হয়েছে।

রাজউক সূত্র জানিয়েছে, বনানী এলাকায় ফ্ল্যাট বা ফ্লোর কিনতে প্রতি বর্গফুটে ৮০০ টাকা বা ৮ শতাংশ কর কিংবা নূনতম ১০ লাখ টাকা কর দিতে হবে। যদি ক্রয় মূল্যের ৮ শতাংশ হারের কর ১০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায় তবে ৮ শতাংশ হারে কর প্রযোজ্য হয়।

আর দলিল মূল্য অনুযায়ী ৮ শতাংশ কর দিলে তা যদি ১০ লাখ টাকার কম হয়, সেক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকেই কর প্রযোজ্য। আর জমির ক্ষেত্রে তা ২০ লাখ। সে অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বাড়িটি কেনাবেচায় অপ্রদর্শিত অন্তত ৩৪ কোটি টাকার বিপরীতে ৩ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) স্টেট ও ভূমি শাখার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জমির বিষয়ে মৌজা প্রতি সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করা আছে। তবে ফ্ল্যাটের বিষয়ে নির্ধারণ করা নেই। এটি ওপেন মার্কেট। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা মিলে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। তবে রাজউক এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে।’

রাজধানীতে জমি, ফ্ল্যাট বা ফ্লোরের দাম সবচেয়ে বেশি গুলশান এলাকায়। চতুর্থ নম্বরে রয়েছে বনানী এলাকা।

বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আরআইইউ) বরাত দিয়ে দেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সম্প্রতি দেশের আবাসন খাতে দামের একটি চিত্র তুলে ধরেছে।

সেই অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ১৪৩ দশমিক ৩১ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা ধরে)।

বনানীতে নির্মিত ৮ হাজার ৭৪টি অ্যাপার্টমেন্ট পর্যালোচনা করে আরআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের নির্মাণ ব্যয় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। সেই হিসাবে বনানীর ওই বাড়ির সবকটা ফ্লোরের নির্মাণ ব্যয়ই হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তাহলে জমিসহ বাড়িটির সাতটি ফ্লোর কি করে ৬ কোটি টাকায় ক্রয় দেখানো হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের রেজিস্ট্রি অফিস সমূহের পরিদর্শক খন্দকার হুমায়ুন কবীর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা পরামর্শ করে অসাধু উপায়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিলে তা ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে পরিদর্শনে এমন কিছু দেখা গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

রিহ্যাব সূত্র বলছে, গত বছর বনানীতে প্রতি স্কয়ার ফিট বিক্রি হয়েছে ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকায়। আর চলতি বছর খরচ আরও ১৫ শতাংশ বেড়েছে। সেই হিসাবে ওই এলাকায় প্রতি বর্গফুট বিক্রি হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে রাজউক এবং চট্টগ্রামে সিডিএ এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের ওপর গেইন ট্যাক্স বর্তমান ৮ শতাংশ।

এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, রাজধানী ও তার আশপাশের ১৭টি কার্যালয়ে জমি বা ফ্ল্যাট নিবন্ধন করা হয়। এসব কার্যালয়ে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের সময় উৎসে কর কেটে রাখা হয়। এনবিআর ওই ১৭টি কার্যালয় থেকে করের হিসাব নিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, গত জুলাই মাসে মাত্র ৩২ কোটি টাকা নিবন্ধন কর পাওয়া গেছে। অথচ ২০২২ সালের জুলাই মাসে এর পরিমাণ ছিল ১০১ কোটি টাকা। আগস্ট মাসেও একই ধারা অব্যাহত থাকে। আগস্টের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ২৪ দিনে ৭৬ কোটি টাকা এসেছে। গত বছর আগস্টে সব মিলিয়ে ১২৬ কোটি টাকা কর পেয়েছিল এনবিআর।

সূত্র মতে, চলতি বছর নিবন্ধনে উৎসে কর আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ১ মাস ২৪ দিনে আদায় হয়েছে ১০৮ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২ শতাংশ।

আরআইইউ বলছে, গত ১৩ বছরে ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম পৌনে দুই গুণ বেড়েছে। ২০১০ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ৮১ দশমিক ২৬ ডলার। ৬ বছর পর তা ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনার আগে গত ২০১৯ সালেও প্রতি বর্গফুটের গড় দাম ছিল ১২৪ দশমিক ৩৪ ডলার। গত বছর সেটি বেড়ে এখন ১৪৩ ডলার বা ১৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে চলতি বছর প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ১৫ শতাংশের মতো বেড়েছে বলে জানান আবাসন ব্যবসায়ীরা।

এমন চড়া দামের মধ্যেও কি করে বনানীর ওই ৪০ কোটি টাকার বাড়ি মাত্র ৬ কোটিতে কেনাবেচা হলো তা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিস্ময়। এ ধরনের কর ফাঁকি রোধে কার্যকর কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না থাকায় উদ্বেগ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।

তবে কর ফাঁকির বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন এনবিআরের আয়কর বিভাগের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, জমি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে কর ফাঁকি বন্ধ করা জরুরি। কর ফাঁকি এবং দলিলে মূল্য লুকানো নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’ পরিকল্পনা করে কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই কর ফাঁকি রোধ হবে বলে পরামর্শ এ বিশেষজ্ঞের।

(ঢাকাটাইমস/২১সেপ্টেম্বর/আরআর/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :