বিদেশে জনশক্তিতে খরা কাটাতে হবে

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে খরা দেখা দিয়েছে— সংবাদ মাধ্যমে এমন একটি খবর যখন প্রকাশ হয় তখন বাংলাদেশের যেকোনো সাধারণ নাগরিকের জন্য তা উদ্বেগের না হয়ে পারে না। এটা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেরই জানা যে, আঠারো কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো জাতীয় আয়ের উৎসই হলো বিদেশে থেকে পাঠানো বাংলাদেশি শ্রমিকদের রেমিটেন্স। রেমিটেন্স কী? রেমিটেন্স কাকে বলে? এটা সম্পর্কেও সকল শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে সবাই অবগত রয়েছেন। প্রবাসী শ্রমিকের কষ্টার্জিত অর্থ নিজে দেশে পাঠানোকেই বলে রেমিটেন্স। রেমিটেন্সের ওপর একটি রাষ্ট্রের প্রধান আয় দাঁড়িয়ে আছে— এই বিষয়টাকে খাটো করে দেখবার কোনো সুযোগ নেই বলেই সংবাদমাধ্যমে আসা এতদসংক্রান্ত খবরটি সকলের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ঢাকা টাইমস’-এর এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়— চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের জনশক্তি রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ওই মাসে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দেওয়া কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ৫৭৪ জন। যা গত ৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং আগস্টের চেয়ে ২২.৪২ শতাংশ কম। এর আগে গত মে মাসে সবচেয়ে কম ১ লাখ ১ হাজার ৫৫৮ সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
মূলত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানি তীব্রভাবে হ্রাস পাওয়ায় সার্বিক এই পতনের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। আগস্টে মালয়েশিয়ায় ৪৬ হাজার ১০৫ জন কর্মী গেলেও সেপ্টেম্বরে তা নেমে এসেছে মাত্র ২১ হাজার ৫২০ জনে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান ৪ গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান এবং কাতারেও জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। তবে সৌদি আরবে এই সংখ্যা বেড়েছে সামান্য। মালয়েশিয়ায় কর্মী রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে বিএমইটির হস্তক্ষেপকেই দায়ী করেছেন শ্রম নিয়োগকারীরা। নতুন কোটা অনুমোদন না হওয়ায় জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
মূলত করোনা মহামারির বিধিনিষেধের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় সম্পূর্ণ থেমে গেলেও ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এই প্রবণতা আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তখন থেকেই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ গত বছর রেকর্ড ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। এটা বিদেশে কর্মী পাঠানোর পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে ভালো অবস্থা বলা যায় নিঃসন্দেহে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ উল্লেখযোগ্য হারে জনশক্তি রপ্তানি কেন কমে গেল তা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা দরকার।
তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে— জনশক্তি রপ্তানি কাজের চাহিদার ওপর নির্ভর করে। যেকোনো দেশেই কাজের কমবেশি চাহিদার হেরফের তো হয়েই থাকে। যেমন: বছরের প্রথম আট মাসে মালয়েশিয়ার বেশির ভাগ কোটা পূরণ হয়ে যাওয়ায় গত মাসে জনশক্তি রপ্তানির সংখ্যা কমে গিয়েছে বলে ধারণা করছেন এ বিষয়ের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ব্যাপারেও একই কথা সেখানে চাহিদা বাড়লে আমাদের দেশের জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
তবে সম্প্রতি জনশক্তি রপ্তানিতে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম বিরূপভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। সিন্ডিকেটের প্রভাবে নিয়োগ খাতে স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে। কয়েকটি সংস্থার কাছে বিএমইটির অগ্রাধিকার থাকায় অনেক সংস্থার জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরবের কিছু রিত্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অসদাচরণের সাম্প্রতিক ঘটনায়ও বাংলাদেশি কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়েছেন। এছাড়া বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে যে এখনো কম বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিকের উৎস হিসেবে ধরে নেওয়া হয়— সেটাকে তো কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এসব বিবেচনায় নিয়ে বৈদেশিক আয়ের এই বড়ো খাতটির দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
সম্প্রতি রেমিটেন্সের এই প্রবাসী আয় কমার কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি পাওয়া যায়। ফলে বেশি লাভের আশায় প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। শ্রমবাজারে নতুন করে যুক্ত হওয়া রেকর্ড পরিমাণ বাংলাদেশির উপার্জিত অর্থের গন্তব্য নিয়েই এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা— যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তারা বলছেন, প্রবাসীরা ঠিকই দেশে থাকা স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে তারা মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অবৈধ হুন্ডিকে। এতে স্বজনরা উপকৃত হলেও ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশ। বাড়ছে না দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলারের বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতার সুযোগে হুন্ডির বাজার জমজমাট হয়ে ওঠায় প্রবাসীরা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। ডলার সংকটের এই সময়ে বৈদেশিক আয়ের এই পতনকে চলমান সংকটে বড়ো দুঃসংবাদ বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রতি বছর হতে আট থেকে নয় লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু নির্দিষ্ট কাজের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে তারা অনেক কম বেতনে চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ অন্যদেশের কর্মীরা দক্ষতার কারণে অনেক বেশি বেতন পাচ্ছেন। এই অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানির কারণে রেমিটেন্স প্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া দালালচক্রের মাধ্যমে বিদেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ কর্মী যাওয়ার ফলে যেটা হচ্ছে সেটা হলো প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যাই শুধু বাড়ছে কিন্তু তাতে রেমিটেন্স বাড়ছে না। এই অদক্ষ কর্মীরা বেশিরভাগই গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে আসা। তাদের নানাভাবে প্রলোভনে ফেলে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নিচ্ছে বড়ো অংকের টাকা। তারা বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও যে টাকায় বিদেশ গেছেন সেই টাকাই তুলতে পারেন না। দুঃখজনক যে— আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের কর্মীদের মান অনেক নিচে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে লাখ লাখ কর্মী বিদেশ গেলেও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে না। গুণগতমান ঠিক করতে না পারলে দেশের শ্রমবাজারগুলো একসময় হারাতে হতে পারে।
দেশের প্রায় এক কোটি কর্মী বিদেশে চাকরি করলেও রেমিটেন্সের পরিমাণ না বাড়ার কোনো কারণ থাকতে পারে— এটা বোধগম্য নয়। বিদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টি করা, হুন্ডির জমজমাট ব্যবসা বন্ধ করা, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বন্ধ করাসহ বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে দ্রুত। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও নতুন নতুন দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাহলেই কেবল বিদেশে জনশক্তিতে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
আলী হাসান: সাংবাদিক

মন্তব্য করুন