যেভাবে এলো পৌষ সংক্রান্তি, সাকরাইন উৎসব

আজ রবিবার পৌষ সংক্রান্তি। পৌষ মাসের ৩০তম দিনটি পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন উৎসব নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও মকর সংক্রান্তি হিসেবেও পালন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তিতে মূলত নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’ উদযাপিত হয়। এই উৎসবকে ঘিরে গ্রাম বাংলায় বাড়িতে বাড়িতে আয়োজন হয়ে থাকে নানান রকমের পিঠা উৎসবের।
পৌষপার্বণ বা পিঠেপার্বণ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে পালিত একটি হিন্দু লোকউৎসব। বাংলা পৌষমাসের সংক্রান্তিতে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিন হিন্দুরা পিঠে প্রস্তুত করে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। পৌষ সংক্রান্তির অপর নাম তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠে সংক্রান্তি। এই প্রাচীন উৎসবের একটি রূপ অদ্যাবধি পিঠেপার্বণের আকারে বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত। মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে নানাপ্রকার পিঠে ও পিঠে গড়ার বিচিত্র সব উপাখ্যানের উল্লেখ রয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। ... 'মকরসংক্রান্তি' শব্দটি দিয়ে নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী 'সংক্রান্তি' একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে।
শহর ভিত্তিক দিনটি উৎসবমুখর ভাবে পালন না হলেও গ্রাম বাংলায় বাড়িতে বাড়িতে দিনটি পালিত হয়ে থাকে নানান আয়োজনে। উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও বহু বছর ধরে পুরান ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে সাকরাইন উৎসব। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবকে ‘পৌষ সংক্রান্তি’ বা ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়ে থাকে। প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বয়ে চলছে পুরান ঢাকরা সাকরাইন বা ঘুড়ি উৎসব।
সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন রূপ নিয়েছে। পৌষ মাসের শেষ দিনে এই সাকরাইন উৎসব আয়োজন করা হয়। তবে বাংলা ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকা তারিখের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্যের কারণে প্রতি বছর দুই দিনব্যাপী এই উৎসবটি পালন করেন পুরান ঢাকা বাসিন্দারা।
তবে রাজধানীর পুরান ঢাকায় এই উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়। সবাই মাতে সাকরাইন উৎসবে। মুঘল আমল থেকে এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকা এলাকার মানুষ এ উৎসবে দিনব্যাপী ঘুড়ি ওড়ান।
সাকরাইনের ঘুড়ি তৈরিতে রয়েছে শৈল্পিক নিদর্শন। সঠিক মাপে ঘুড়ি তৈরি করতে না পারলে ঘুড়ি আকাশের নীল রঙ ধরতে পারবে না। এজন্য বাহারি রঙের ঘুড়ি তৈরি করা হয় সাকরাইন উৎসবে। সেগুলোর মধ্যে গোয়াদার, চোকদার, মাসদার, গরুদান, লেজলম্বা, চারভুয়াদার, পানদার, লেনঠনদার, গায়েল ঘুড়িগুলো অন্যতম।
বাহারি রঙের কাগজ, পলিব্যাগ ও বাঁশের অংশবিশেষ দিয়ে তৈরি হয় এসব ঘুড়ি। সঙ্গে থাকে বাহারি রঙের নাটাই। এ ছাড়া নাটাই ও ঘুড়িতে সংযোগ করা হয় বাহারি রঙের সুতা। সেসব সুতার মধ্যে রক সুতা, ডাবল ড্রাগন, কিংকোবরা, ক্লাক ডেবিল, ব্লাক গান, ডাবল গান, সম্রাট, ডাবল ব্লেট, মানজা, বর্ধমান, লালগান ও টাইগার অন্যতম। এসব বাহারি ঘুড়ির মালিককে নিয়ে আয়োজন করা হয় ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা।
উল্লেখ্য, সাকরাইন উৎসব যদিও পুরান ঢাকার ঐতিহ্য, তবে কালের পরিক্রমায় এ ঐতিহ্য পুরান ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। সাকরাইন উৎসব ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এদিন পুরান ঢাকার বাড়িগুলোর ছাদ যেন বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়। যেকেউ ঘুড়ি নিয়ে এ উৎসবে অংশ নিতে পারবেন। এ উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত, সার্বজনীন।
ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, নারিন্দা, নবাবপুর, ওয়ারি, গেণ্ডারিয়া, পোস্তগোলা, হাজারীবাগ, লালবাগ ও এর আশপাশ এলাকাগুলোয় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠে এ উৎসবে। দিনভর ঘুড়ি উড়িয়ে সন্ধ্যায় বিভিন্ন আয়োজনে সবাই আনন্দে মেতে ওঠেন।
সাকরাইন উৎসব নাগরিক উৎসব মনে হলেও, এর সঙ্গে লোকঐতিহ্য ও উদযাপনের যোগ আছে। মূল আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো।
শীতের বিকেলে ঘুড়ির কাটা-কাটি খেলায় উত্তাপ ছড়ায় সাকরাইন উৎসব। এক দশক আগেও ছাদে ছাদে থাকতো মাইকের আধিপত্য। আজ মাইকের স্থান দখল করেছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। উৎসবের আমেজ থাকবে পুরান ঢাকার সর্বত্র। আকাশে উড়বে ঘুড়ি আর বাতাসে দোলা জাগাবে গান। মাঝে মাঝে ঘুড়ি কেটে গেলে পরাজিত ঘুড়ির উদ্দেশে ধ্বনিত হবে ভাকাট্টা লোট শব্দ যুগল।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে বাড়বে ঘুড়ির সংখ্যা, বাড়বে উৎসবের রঙ। সব মিলিয়ে রঙিন ঘুড়িতে ছেয়ে যাবে ঢাকার আকাশ। সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানোর পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে। কালের ধারাবহিকতায় সাকরাইন উৎসবে অনুষঙ্গের পরিবর্তন এলেও আমেজ ও আবেগটা কিন্তু এখনও প্রজন্মান্তরে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই।

মন্তব্য করুন