বিনিরাইলের মাছের মেলায় জামাই-শ্বশুরের মাছ কেনার প্রতিযোগিতা

৭০ কেজি ওজনের একটি বাঘাইড় মাছ। এটি কিনতে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন স্থানীয় ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা। সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার টাকা দাম উঠলেও আরও বেশি দামের আশায় মাছটি বিক্রি করছেন না বিক্রেতা। চলছে দর কষাকষি। এভাবেই জমে উঠেছে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইলের মাছের মেলা। অবশ্য এ মেলা অনেকের কাছে জামাই মেলা হিসেবেও অধিক পরিচিত।
প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মাঘ মাসের প্রথম দিনে বসে ঐতিহ্যবাহী বিনিরাইলের এই মেলা। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সোমবার (১৫ জানুয়ারি) সকালেও বসেছে আড়াইশ বছরের পুরোনো মেলাটি।
একদিনের এ মেলায় ঢল নামে হাজারো মানুষের। সকাল থেকেই জমে উঠে মেলা। মেলা উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে শ্বশুর বাড়িতে আসেন এ এলাকার জামাইরা। এলাকার উৎসুক জনতা ও শ্বশুরদের পাশাপাশি তারাও মেলায় ভিড় করেন।
সরেজমিন মেলা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ২ শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বিভিন্ন প্রকার মাছ নিয়ে দোকান সাজিয়েছেন। এর মধ্যে সামুদ্রিক চিতল, বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, কালী বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, ইলিশ, কাই কলা ও রূপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশি মাছ। মাছ ছাড়া আসবাবপত্র, খেলনা ও মিষ্টি নিয়েও বসেছে দোকানিরা।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, বিনিরাইল গ্রামের মাছের মেলা আশপাশের কয়েক জেলার মানুষের উপস্থিতিতে দিনভর সরগরম থাকে। চলে আনন্দ-উৎসব। আর এ দিনটির জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন স্থানীয়রা। কারণ এটা মাছের মেলা হলেও এখানে চলে এলাকার জামাইদের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতা। বিনিরাইল এবং এর আশপাশের গ্রামে যারা বিয়ে করেছেন সেই জামাইরা হচ্ছেন মেলার মূল ক্রেতা।
তবে পিছিয়ে থাকেন না শ্বশুররাও। মেলাকে ঘিরে জামাই-শ্বশুরদের মধ্যে চলে মাছ কেনার নীরব প্রতিযোগিতা। জামাইরা চান সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে শ্বশুর বাড়িতে যেতে। আবার শ্বশুররাও চান সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে জামাইকে আপ্যায়ন করাতে।
কথিত আছে, পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে ১৮ শতকে মেলাটির প্রচলন হয়। মূলত মাছ মেলা হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এটি জামাই মেলা নামে পরিচিতি পেতে থাকে। প্রতি বছর মেলাকে কেন্দ্র করে বিনিরাইল ও আশপাশের কয়েক গ্রামের শ্বশুররা তাদের মেয়ের জামাইকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানান। মেয়েরা তাদের স্বামীদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। আর জামাইরা মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুর বাড়িতে যান। এভাবে একসময় মেলাটি জামাই মেলা নামে পরিচিতি পেয়ে যায়।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, উপজেলার জাঙ্গালিয়া, বক্তারপুর, জামালপুর ও মোক্তারপুর ইউনিয়নের চার মোহনায় বিনিরাইল গ্রামে বসে এই মেলা। প্রায় ২৫০ বছর ধরে ধান কাটার পর ওই জমিতে স্থানীয়রা এ মেলার আয়োজন করেন। মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল আকৃতির মাছ। মেলা উপলক্ষে আশপাশের প্রতিটি বাড়ি মেয়ে, মেয়ে জামাই, নাতি-নাতনি ও আত্মীয়-স্বজনে ভরে যায়। ঈদ, পূজা পার্বণ বা অন্য কোনো উৎসবে দাওয়াত পেয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসতে না পারলেও মাছের মেলায় জামাইরা ঠিকই আসেন। বলতে গেলে এটি এক প্রকার রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
মেলায় নানা ধরনের মাছের পাশাপাশি হরেক রকম মিষ্টিও বিক্রি হচ্ছে। প্রকার ভেদে প্রতি কেজি মিষ্টি ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। ১ কেজি ওজনের একটি বালিশ আকৃতি মিষ্টি বিক্রি হয় ৫০০ টাকায়। এছাড়া মেলায় কাঠ ও স্টিলের আসবাবপত্র, ফল, খেলনা, নানা ধরনের আচারসহ সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায় এ মেলায়। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে বেশ কিছু আয়োজন।
তবে মেলায় ইচ্ছামতো টোল আদায় ও কিছু অব্যবস্থাপনার অভিযোগও রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর থেকে আসা জামাই মিঠু সূত্রধর বলেন, বহু বছরের পুরোনো মেলাটি দেখার খুব শখ ছিল। শ্বশুর বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ করায় সুযোগটি হাতছাড়া করিনি। মেলায় ঘুরছি, কিছু মাছ শ্বশুর বাড়ির জন্য নিয়ে যাবো।
স্থানীয় যুবক আশরাফুল বলেন, কর্মব্যস্ততা থাকলেও হৃদয়ের টানে ছুটে আসি এ মেলায়।
মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, মেলার আকর্ষণ বাড়াতে বড় বড় মাছ নিয়ে আসেন তারা। কিন্তু মাছের মেলায় ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর ভিড় বেশি বলে জানান তারা। তবে বেচা-কেনাকে মুখ্য মনে না করে স্থানীয় মানুষের সাথে সম্পর্কের কারণে এ মেলায় আসেন বলেও জানান তারা।
মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি কিশোর আকন্দ বলেন, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু হওয়া বিনিরাইলের মাছের মেলাটি এখন রূপ নিয়েছে ঐতিহ্যে। এ মেলা স্থানীয়দের কাছে সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। এটি এই এলাকার মানুষের হৃদয়ের খোরাক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কালীগঞ্জ থানার অফিসার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহাতাব উদ্দিন বলেন, মেলাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে পুলিশের টহল থাকবে। পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন সেখানে অবস্থান করবে। মেলা এলাকায় কোনো ধরনের জুয়া এবং অশ্লীল কার্যকলাপ করার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজিজুর রহমান বলেন, বিনিরাইলের মাছের মেলাটি স্থানীয় একটি ঐতিহ্য। বহু বছরের পুরোনো এই মেলাকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে রয়েছে নানা ধরনের কথা। তবে ইতিহাস ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে গ্রাম-গঞ্জে এ ধরনের আয়োজন সত্যি আমাদের চিরায়ত বাংলার রূপই ফুটে উঠে।
(ঢাকাটাইমস/১৫জানুয়ারি/প্রতিনিধি/পিএস)।

মন্তব্য করুন