খরস্রোতা বেগবতী নদী এখন মরা খাল, পুনর্খননের দাবি
ঝিনাইদহের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ে খরস্রোতা বেগবতী নদীটি নাব্য হারিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে জেলার প্রতিটি জায়গায়ই এই নদীটি প্রভাবশালীদের অবৈধ দখল ও দূষণের কারণে ভরাট হয়ে একেবারেই সংকুচিত হয়ে গেছে। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও বেগবতী নদীতে পানি থাকতো ভরপুর। ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নদী পথে দানব আকৃতির লঞ্চ, স্টিমার ও বড় বড় নৌকা নিয়ে ঝিনাইদহসহ কালীগঞ্জ অঞ্চলে ধান, পাট ক্রয় করতে আসতো ব্যাপারীরা। ধানের বিনিময়ে কুমার সম্প্রদায়ের লোকজন আসতো মৃৎ শিল্পের হাড়ি পাতিলসহ বিভিন্ন বাসন কোসন বিক্রয় করত। নদির দু’পাড়ের জেলে, বাগদি সম্প্রদায়ের লোকজন সারা বছর বেগবতী নদীতে মাছ ধরে এলাকার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মাছ কিনে খাওয়া লাগতো না নদীর পাড়ের কৃষকদের। নদীর মাছ দিয়েই তাদের পূরো বছর চলে যেত সাথে পূরণ হতো আমিষের চাহিদা। বর্তমান নদীতে বড় বড় নৌকা তো দূরের কথা নদীর অনেক স্থান শুকিয়ে গিয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। এই নদীর মধ্যে চাষ হচ্ছে ফসলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি। এক সময়ের খরস্রোতা বেগবতী নদীর পানির এতোটাই বেগ ছিল যে, এই নদীর পানির গতিসম্পন্ন বেগের জন্য এই নদীর নাম করা হয়েছিল বেগবতী।
বেগবতী নদীটি মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙা নদী থেকে শুরু হয়ে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের বিলাঞ্চল হয়ে মাগুরা জেলার একটি নদীতে মিশেছে। অতঃপর এই নদীর জলধারা কবাই, হানুয়া, আঙ্গারিয়া, মুরাদিয়া, বিষয়খালী, নলডাঙ্গা বাজারের পাশদিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোলা বাজারের বড় রায়সা গ্রামের পাশ অতিক্রম করে মাগুরা জেলার সদর উপজেলার রাঘবদাইড় ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে ফটকি নদীতে নিপাতিত হয়েছে।
বেগবতী নদীর দৈর্ঘ্য ৫৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩২ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা (পাউবো) কর্তৃক বেগবতী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৬৩ নং নদী। বেগবতী নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙা নদীর একটি শাখা নদী।
নদী পাড়ের বাসিন্দা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তৈলকূপী গ্রামের মীর আরিফ বাক্কু জানান, অবৈধ দখলদারদের দখল উৎসব ও দূষণের কারণে এবং সময়ের বিবর্তনে নদীটি এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। ভরা মৌসুমেও ঢেকে আছে কচুরিপানায়। এই নদীটি রক্ষায় এগিয়ে আসেনি কেউ, কারোর কানে পৌঁছায় না বেগবতী নদীর নীরব কান্না! এই নদীটি যে-সব অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সে অঞ্চলের শোভা বর্ধনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নদীটির অংশীদারিত্ব অসম।
বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিটির কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী শিবু পদ বিশ্বাস বলেন, বেগবতী নদীটি ঝিনাইদহ সদর উপজেলা থেকে মাগুরা জেলার ফটকি নদী পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৫৩ কিলোমিটার গড় প্রস্থ ৩২ মিটার। আমরা আগে দেখেছি বেগবতী নদী যে সমস্ত হাট বাজার বা শহর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সেই সমস্ত এলাকায় নৌবন্দর ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লঞ্চ, স্টিমার ও বড় বড় নৌকা বাণিজ্য করতে আসতো এসব নৌবন্দরে। এখানে মনোমুগ্ধকর ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল অসম্ভব নান্দনিক। এখন আর এসবের কিছুই নেই। দখল ও দূষণের কারণে দু’পাড়ের প্রভাবশালী সুবিধাবাদী মহল ময়লা আবর্জনা ফেলে নদী ভরাট করে দখল করে নিয়েছে নদীর সিংহভাগ। দখলের পর স্থায়ী ভবনসহ মার্কেট, বিভিন্ন কলকারখানার ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলে দূষিত করা হচ্ছে পানি। আমরা চাই সরকারি উদ্যোগে নদীটি দখলমুক্ত এবং খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে পানি চলাচল স্বাভাবিক হোক। যাতে নদীতে বারো মাস পানি থাকে। আর পানি থাকলেই নদী পথে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধাসহ বিলুপ্তপ্রায় সকল দেশীয় প্রজাতির মাছ বংশ বিস্তার করবে এবং আমিষের ঘাটতি পূরণ হবে। তাই বেগবতী নদীসহ জেলার মধ্যে প্রবাহিত নবগঙ্গা, চিত্রা, বুডি, ভৈরবা, গড়াই, কপোতাক্ষসহ সকল নদ-নদী দখলমুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, ৬৩ জেলার খাল খনন প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায়ে ধরে দিয়েছি এটা পাশ হলে এর কার্যক্রম শুরু হবে। এটা একনেকে টার্নিক কমিশন থেকে অবজারভেশন দিয়েছে ওটা করে আবার জমা দিলে তারপর পাস হবে। তারপর অবৈধ দখলমুক্ত এবং খনন কার্যক্রম শুরু হবে। তবে কতদিনের মধ্যে হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
(ঢাকাটাইমস/১৪মার্চ/এআর)