যশোরে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার ‘হরিলুট’ অনুসন্ধানে দুদক

যশোর প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ১২ মে ২০২৪, ০৯:২৮

যশোরে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ‘হরিলুটের’ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরইমধ্যে দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং অভিযোগকারীদের বক্তব্য নিয়েছে দুদক। পাশাপাশি সংস্থাটির ব্যাংক হিসাব স্থগিত রাখা হয়েছে।

অভিযোগকারীদের দাবি, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থা ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ৭৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পে অন্তত ৩০ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। ঝরে পড়া শিশুদের জন্য এ প্রকল্পের স্কুলগুলোর বাড়িমালিকদের বেশিরভাগই ভাড়া পাননি।

বেতন বকেয়া রয়েছে শিক্ষক ও সুপারভাইজারদের। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের পোশাক, ব্যাগ। নিয়োগ দেওয়া হয়নি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। সরবরাহ করা হয়নি উপকরণ। ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বরং প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তৈরি করে টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, সেটিও নিজেদের তৈরি করা।

এসব বিষয় তুলে ধরে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের ঝরে পড়া শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতি জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়।

যশোরে লিড এনজিও হিসেবে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ছয়টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় (দুটি এরিয়ায় বিভক্ত করে ১ ও ২) প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

অভিযোগকারীদের দাবি, কার্যক্রম শুরুর আগে ঝরে পড়া শিশুর তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ৩০ জুন (২০২৩) প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষক, সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলের জন্য ভাড়া নেওয়া ঘরের ভাড়া পাননি বেশিরভাগ বাড়ির মালিক।

সূত্র জানায়, যশোর পৌরসভাসহ ছয়টি উপজেলার ৪৮১টি স্কুলকেন্দ্রের (শিখন কেন্দ্র) বেশিরভাগই ভাড়া বকেয়া রয়েছে। এ খাতে বকেয়ার পরিমাণ দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা। শিক্ষকদের প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেই টাকা পাননি। অধের্কের বেশি বেতন বকেয়া। এমনকি পাঁচ হাজার টাকার সোশ্যাল বেনিফিটের একটি দিয়ে আরেকটি হজম করে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। সোশ্যাল বেনিফিটের এ খাতে ২৪ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে।

প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ ও উপকরণ সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর খাতে দুই বছরে ১২ হাজার টাকা হিসেবে ৪৮১টি শিখন কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে ৫৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এসব টাকা ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে এনজিও কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগকারীদের দাবি।

বাঘারপাড়ার নরসিংহপুর গ্রামের কেন্দ্রের শিক্ষক জেসমিন নাহার জানান, তিনি স্কুলের ছাত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে দুই বছর শ্রম দিয়েছেন। বেতন পেয়েছেন মাত্র এক মাসের। স্কুলের ভাড়ার জন্য চাপ দেওয়ায় তাকে বাদ নিয়ে নতুন শিক্ষক নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি বকেয়া বেতন পাননি।

দুদকে অভিযোগকারীদের একজন বাঘারপাড়া উপজেলার প্রোগ্রাম সুপারভাইজার আব্দুর রহিম বলেন, শিক্ষকদের অনেক মাসের বেতন বাকি, শিখন কেন্দ্রের ভাড়া বাকি। কেন্দ্রের ভাড়া ৫০০ টাকা দিয়ে মালিকদের শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে তদন্তে গেলে ১২০০ টাকা ভাড়া পান বলে জানাতে। তাহলে পরে ওই টাকা ভাড়া দেওয়া হবে। শিক্ষকদের সোশ্যাল বেনিফিটের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কোনো কেন্দ্রে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তিনি নিজেও ১১ মাসের বেতন পাবেন। অথচ এসব টাকা প্রকল্প থেকে তুলে নিয়েছেন দিশার কর্মকর্তারা।

তিনি আরও বলেন, ৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পে অন্তত ৩০ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। দুদকে অভিযোগ করার পর কর্মকর্তারা তার কাছে এসে আপসের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি মাথা নত করেননি। তিনি দুর্নীতিবাজদের শাস্তি চান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগের পর দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয় অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংস্থার কার্যক্রমের নথিপত্র-তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে। দিশার ব্যাংক হিসাবও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে যশোর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস জানান, দিশার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করছে দুদক। দুদক তার কাছে যেসব কাগজপত্র চেয়েছিল, তিনি তা সরবরাহ করেছেন।

তবে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানা দাবি করে জানান, অনিয়ম-দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যা। ব্যাংক হিসাব স্থগিতের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, ‘পরে আবেদন করে হিসাব চালুর পর শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়েছে।’

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আল-আমিন বলেন, তারা অভিযোগের অনুসন্ধান করছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা প্রকল্পের কাগজপত্র পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবেন। এরপর আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/১২মে/এজে)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :