প্রয়োজন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
 | প্রকাশিত : ২৩ মে ২০২৪, ১০:৫৬

বাংলাদেশে বিজয়ের আনন্দ সংহতকরণ প্রক্রিয়াটি অন্যকিছুর পাশাপাশি গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে সম্পৃক্ত। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এ বছরের ৭ই জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়াটা একান্ত প্রয়োজন ছিল বলেই মনে করি; শেষ পর্যন্ত সেটা যে হয়েছে, এটা বাংলাদেশের জন্য সার্বিক দিকেই ইতিবাচক। এটার প্রয়োজন ছিল এই জন্য যে- বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কর্তৃক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল- মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য এটা চালু করাটা ছিল বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক দালাল আইনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনাসমর্র্থিত স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান তা বন্ধ করে দিয়েছিল। এর প্রায় ৩৫ বছর পরে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনরায় গঠনের পর সেই বিচারপ্রক্রিয়া আবার চালু হয়েছে এবং তা অদ্যাবধি চলমান রয়েছে।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী পরাজিত শক্তির দোসররা এখনো সুযোগ পেলেই আগের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে মানুষ হত্যা করতে পিছপা হয় না। এর সত্যতা দেখা যায়- গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিহত করার অজুহাতে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর অবরোধ-হরতালের নামে বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে নির্বিচারভাবে। এই সময় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বাহন ট্রেনেও তারা ঘটিয়েছে অগ্নি-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ব্যাপক প্রাণহানির মতো নাশকতার ঘটনা। এতে ঐ সময় আতঙ্কিত হয়ে ওঠেছিল শুধু ট্রেনযাত্রীরাই নয়- বলা যায় সারা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষরাও।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে ৩রা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের চারদিক থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে তারা টিকতে না পেরে পিছুহটে গিয়ে বড়ো শহরগুলোতে সমবেত হতে থাকে। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাদের ছোটো ছোটো দল মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে।

১৬ই ডিসেম্বর দিনটি বাঙালি জাতির জন্য চিরায়তভাবে ঐতিহাসিক বিজয়ানন্দের বার্তাবাহী হয়ে আছে এখনো। ওই দিন বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান) এই আত্মসমর্পণের দলিলে সই হয়। এতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর পক্ষে সই করেন কমান্ডার-ইন-চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, আর যুদ্ধরত পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছিলেন তখনকার বিমান বাহিনীর প্রধান ও মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার।

ভারতের পক্ষে ছিলেন সে দেশের তখনকার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ লে. জেনারেল জ্যাকব রাফায়েল জ্যাকব। আর পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরীফ ও পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল প্যাট্রিক ডি কলাঘান। আত্মসমর্পণের দলিলটি ছিল ইংরেজিতে।

আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে নির্বিচারে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। আজ থেকে ৫৩ বছর আগের এইসব গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনও আসেনি। আর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিচারও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এই আদালতের কার্যক্রম প্রত্যাশিত গতিতেই চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিচার সম্পন্নও হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে টানা চতুর্থবারের জন্য নির্বাচিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকার। এ চেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্যই সংগত কারণে বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন ছির বলে মনে করি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় কুখ্যাত সহযোগী বাহিনী রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস্ কর্তৃক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটন দেশে-বিদেশে সকলেরই জানা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বর্বর অপরাধ সংঘটনে যেসব ব্যক্তি অংশ নিয়েছিল এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেছিল এবং উস্কানি ও প্ররোচনা দিয়েছিল তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালে ২৪শে জানুয়ারি ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২’ প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির ৮ নং আদেশের মাধ্যমে জারি করা হয়। এই আইনটি দালাল আইন, ১৯৭২ হিসেবে পরিচিত ছিল। দালাল আইনের অধীনে প্রায় ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনা হয়। ঐ আইনটি বলবত থাকা সত্ত্বেও ১৭ই জুলাই ১৯৭৩-এ তৎকালীন আইনমন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধর জাতীয় সংসদে ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) বিল, ১৯৭৩’ সংসদের বিবেচনার জন্য উত্থাপন করেন। উত্থাপনের পরে বিলটির ওপর রিপোর্ট পেশের জন্য বাছাই কমিটিতে প্রেরণ করার প্রস্তাব করা হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাননীয় সংসদ সদস্য বিলটির ওপর ব্যাপক আলোচনা ও মতামত প্রদান করেন এবং ওই দিনই বিলটি সর্বসম্মতভাবে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়।

কিন্তু একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দোসররা ষড়যন্ত্র করে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাদের বিরুদ্ধে বিচার থেমে যায়।

১৯৭৫-এর ৩১শে ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়; উপরন্তু সে সময় চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ১১ হাজার আসামি, এমনকি সাজাপ্রাপ্তরাও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায়।

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পরে ২০০৮-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে ’৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এই অঙ্গীকারের সূত্র ধরে ২৯শে জানুয়ারি, ২০০৯ বৃহস্পতিবার নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের তৃতীয় বৈঠকে মাননীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী (সিলেট-৩) কর্তৃক উত্থাপিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব ‘সংসদের অভিমত এই যে, দেশের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হউক’ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১০ সালের পর থেকে গত ১৩ বছরে ৫১টি মামলার রায় হয়েছে। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের সন্নিবেশিত তথ্য অনুযায়ী বিচার ও প্রাক্‌-বিচার (তদন্ত শেষ হয়েছে) পর্যায়ে রয়েছে ৩৫ মামলা। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে করা ৪০টি আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ। এ হিসেবে যাত্রা শুরুর ১৩তম বছর পূর্ণ হয়ে ১৪তম বছরে পদার্পণ করেছে। পরে ২০১২ সালের ২২শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) চলছে বিচারকাজ। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪০টি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যমতে, দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। তাঁদের মধ্যে ৪৪ জন পলাতক। দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ৪০ আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। বিচার ও প্রাক্‌-বিচার পর্যায়ে রয়েছে ৩৫ মামলা। এ পর্যন্ত ছয়জনের ফাঁসিসহ সাত আসামির দণ্ড কার্যকর হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ৩৫টি মামলার বিচার চলছে। এসব মামলার আসামি ২১৪ জন। এ ছাড়া সাতশর বেশি অভিযোগের তদন্ত চলছে। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সুসংহতকরণের লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখা বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই অপরিহার্য। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার তা আবার শুরু করেছেন। আমরা আশা করি- গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো যে সরকার গঠন করেছে- নির্বাচিত এই গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারাই কেবল ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলমান থাকবে। এর পাশাপাশি আমাদের প্রত্যাশা এই সরকারের মাধ্যমেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্তি সম্ভব হবে।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :