ঈদযাত্রায় স্বাস্থ্য সতর্কতা

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
  প্রকাশিত : ১৪ জুন ২০২৪, ১০:২৫| আপডেট : ১৪ জুন ২০২৪, ১০:৩৩
অ- অ+

বিশ্বজুড়ে মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। প্রতিবছর এক অনন্য-বৈভব বিলাতে এই ঈদ নিয়ে আসে খুশির বার্তা। ঈদ মানে আনন্দের জোয়ার। ঈদ মানে খুশির সঞ্চার। দীর্ঘ এক বছর পর পবিত্র জিলহজ মাসে ঘটে এই কুরবানি ঈদের আগমন। সব মুসলমান এদিন হরেক রকমের মুখরোচক খাবারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন জামা কাপড় পরিধান, ঈদগাহে নামাজ পড়া আর কোলাকুলি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন।

সবাই চায় এই সময়টাতে পরিবার পরিজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে, আর তাই ইতোমধ্যে ঈদকে ঘিরে নাড়ির টানে বাড়ি ছুটছে সবাই। রাস্তায় দেখা যাচ্ছে ঘরমুখো মানুষের ঢল। তবে ঈদ-ভ্রমণে স্বাস্থ্যঝুঁকির খুঁটিনাটি জানা থাকলে ভ্রমণটি হতে পারে আরও আনন্দময়। যাত্রাপথে, বিশেষ করে যারা দূরদূরান্তে যান, তাদের রাস্তাঘাটে পোহাতে হয় হাজারো দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনা। তারপরও বাসায় ফেরার আনন্দে মন থাকে মাতোয়ারা। তাই কষ্টগুলো আর বড়ো হয়ে ওঠে না। এই সময়টাতে অনেককেই ভ্রমণ করতে হয় বাস, ট্রেন অথবা লঞ্চে। রাস্তায় যানজট, ফেরি স্বল্পতা ও পারাপারের সংকট, লঞ্চ স্টিমারে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি। প্রচণ্ড ভিড় আর ঠেলাঠেলি করে ক্লান্তিকর ও দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে বাড়ি পৌঁছাতে হয়, আবার ছুটি শেষে কাজে যোগদান করতে হয়। সবাই চায় নির্বিঘ্নে আর নিরাপদে ঘরে ফিরতে। তবে যাওয়া-আসার ঝুঁকিতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিশু, বয়স্ক এবং রোগীদের পক্ষে লম্বা যাত্রাপথের ধকল সহ্য করা খুব কঠিন হয় বইকি। তাই যাত্রাপথে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। অন্যথায় ঈদের আনন্দ আগেভাগেই মাটি হয়ে যেতে পারে। তাই ঈদ ভ্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়াটা কোনোক্রমেই কাম্য নয়।

ভ্রমণের জন্য ব্যাগ গোছানো: গোছগাছের ব্যাপারটির সঙ্গে কোথায় যাওয়া হচ্ছে এবং কতদিন থাকতে হবে তা জড়িত। অবশ্যই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ এমনকি ছোটো বাচ্চা বা বয়স্কদের জন্য যা যা দরকার, তা সঙ্গে রাখা উচিত। যতটা সম্ভব অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দেওয়া ভালো।

পরিধেয় পোশাক: এখন গরমের সময়। তাই ভ্রমণের সময় হালকা, আরামদায়ক ও সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন পোশাক পরা উচিত। টাইট কাপড়-চোপড় পরিহার করাই ভালো। এতে ভ্রমণ হয়ে উঠবে আরামদায়ক। নরম জুতা বা স্যান্ডেল পরা উচিত। আবার একেবারে নতুন জুতো পরে কোথাও রওনা হবেন না, এতে পায়ে ফোস্কা পড়তে পারে। মেয়েদের জন্য হাইহিল পরিহার করে ফ্ল্যাট জুতা পরা উচিত।

যানবাহনে সতর্কতা: জানালা দিয়ে মাথা বা হাত বের করে রাখবেন না। অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে বাস, ট্রেন বা লঞ্চে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন। বাস বা ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করা খুবই বিপদজনক, তাই ছাদে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন।

খাবার নিয়ে সতর্কতা: বাইরের খাবার এবং পানীয় কোনোভাবেই গ্রহণ করা ঠিক হবে না। ঘরের তৈরি খাবার ও পানির বোতল সঙ্গে নেওয়া উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী বিশুদ্ধ পানি পান করুন এবং বাচ্চাদেরও পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করাবেন। ভ্রমণে খাদ্য ও পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে বেশি।

প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ফার্স্ট এইড বক্স: ঈদের সময় জরুরি ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ ফার্স্ট এইড বক্স নেওয়া উচিত। কারণ কোনো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সময় ওষুধ পাওয়া যায় না। জ্বর, মাথা বা শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল; পেটের পীড়ার জন্য মেট্রোনিডাজল; পেটে গ্যাস, পেটফাঁপা, বুক জ্বলার জন্য এন্টাসিড, ল্যান্সোপ্রাজল বা ওমিপ্রাজল; সাধারণ সর্দি কাশির জন্য এন্টি-হিস্টামিন; ডায়রিয়ার জন্য ওরাল স্যালাইন ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। এছাড়াও তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, স্যাভলন ইত্যাদি সংগ্রহে রাখুন। হাত কেটে গেলে কিংবা শিশুরা খেলতে গিয়ে শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে এগুলো তখনও সহায়ক হবে। নোটবুকে আপনার পরিচিত চিকিৎসক ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে রাখলে ভালো হয়।

জরুরি প্রয়োজনে: পরিচিত ডাক্তার এবং পুলিশের ফোন নাম্বার সঙ্গে রাখুন। অসুস্থ বা কোনো বিপদে পড়লে যেন সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ ও বিপদের সময় পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। পুলিশের সাহায্য নিতে যেকোনো জায়গা থেকে ৯৯৯-এ ফোন করবেন।

যারা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন: যারা বিভিন্ন রোগে ভোগেন, যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, বাতরোগ, অ্যাজমা বা অ্যালার্জি, তারা অবশ্যই ঈদ ভ্রমণে প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। ইনহেলার, ইনসুলিন ইত্যাদিও সঙ্গে রাখবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা লজেন্স, সুগার কিউব সঙ্গে নেবেন। প্লেনে ভ্রমণ করলে ঘন ঘন পা ম্যাসাজ করতে হবে, না হলে পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস হতে পারে। তারা পায়ে রক্তজমা প্রতিরোধকারী মোজা পরতে পারেন। যাদের ওজন বেশি তারাও এ কাজটি করতে পারেন।

মোশন সিকনেস: অনেকেরই বাসে বা যানবাহনে উঠলে মাথা ঘোরা, বমি-বমি ভাব এমনকি বমি হয়ও, যাকে বলে ভ্রমণজনিত মোশন সিকনেস। এ সমস্যা প্রতিরোধে স্টিমেটিল বা ভার্গন ট্যাবলেট ভ্রমণের আধা ঘণ্টা আগে খেয়ে নেবেন। এছাড়াও বাস বা ট্রেন চলাকালে বাইরের দিকে তাকিয়ে না থেকে চোখ বন্ধ রাখুন, ঘুমিয়েও নিতে পারেন। যাত্রাপথে অনেকে বই পড়ে সময় কাটান। এই অভ্যাসটা ভালো, কিন্তু যারা মোশন সিকনেসে ভোগেন, তারা ভ্রমণের সময় বইপড়া পরিহার করুন। কারণ যানবাহনের দুলনির সঙ্গে সঙ্গে বই পড়ার ফলে মাথা ঘোরা শুরু হতে পারে, পরে বমিও হতে পারে। তাই সতর্ক হতে হবে।

শিশুদের নিয়ে বাড়তি সতর্কতা: ট্রেনে, বাসে কিংবা লঞ্চে ভ্রমণের সময়ে শিশুরা সব সময়েই জানালার ধারের সিটটি পছন্দ করে। এ কারণে হঠাৎ করে অতিরিক্ত বাতাসের মুখোমুখি হয়। ফলে শিশুরা অনেকে ঠিক ভ্রমণের পর পরই আক্রান্ত হয় সর্দি-জ্বর কিংবা সাধারণ কাশিতে। এছাড়াও বাইরের পানীয় এবং খাবার খেয়ে বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাই তারা যাতে যাত্রাপথে বাইরের খাবার না খায়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকুন। একেবারে ছোটো দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে ভ্রমণ না করাই উচিত। প্রয়োজনে বের হতে হলে তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। চলার পথে শিশুকে অবশ্যই ধরে রাখবেন- ট্রেন, বাস বা লঞ্চ থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। খেয়াল রাখবেন কোনো বাচ্চা যেন জানালা দিয়ে হাত বাইরে না রাখে।

বয়স্কদের সতর্কতা: দীর্ঘ ভ্রমণ বয়স্কদের জন্য বেশি কষ্টসাধ্য। বিভিন্ন রোগসহ অনেকেই বাতজ্বর বা আরথ্রাইটিসে ভোগেন। তাদের জন্য বাসে বা ট্রেনে ওঠাও সহজ নয়, সে সময় তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। যাত্রাপথে যেন তারা একই ভঙ্গিতে বেশিক্ষণ বসে না থাকে এবং মাঝেমধ্যে যানবাহনের মধ্যেই যেন কিছুক্ষণ চলাফেরা করেন, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন। তা না হলে বাতের ব্যথা বাড়তে পারে, এমনকি পায়ে পানি জমে পা ফুলেও যেতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ভ্রমণে করণীয়: গর্ভবতী মহিলারা অতিরিক্ত ঝাঁকি হয় এমন পথে ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করুন। প্রথম তিন মাস ও সম্ভাব্য ডেলিভারির দুই তিন মাস আগে ভ্রমণ এড়িয়ে চলাই ভালো। যাদের ইতঃপূর্বে গর্ভপাতের ইতিহাস আছে তাদের গর্ভাবস্থায় ভ্রমণ করা উচিত নয়। বিশেষ করে শেষ তিন মাস যেকোনো গর্ভবতীর ভ্রমণ করা নিষেধ। গর্ভাবস্থায় একা ভ্রমণ না করা উচিত। নিরাপদ মাতৃত্বের স্বার্থে কোনো ধরনের বিপদের ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না।

অজ্ঞান পার্টি থেকে সাবধান: যাত্রাপথে মলম পার্টি ও ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বেশি থাকে তাই সতর্ক থাকুন। যানবাহনে অপরিচিত কেউ খাদ্য বা পানীয় দিলে খাবেন না। কারণ, প্রায়ই শোনা যায় এ ধরনের খাবার খেয়ে অনেকেই বড়ো দুর্ঘটনায় পড়েছেন। কাজেই এই বিপদ এড়াতে সচেতন থাকবেন।

বাড়তি সতর্কতা: ঈদে ঘরমুখো মানুষগুলো বাড়ি যাওয়ার জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে চড়ে ঝুঁকিপূর্ণ সফর করেন, এতে অনাকাক্ষিত বিপদ-আপদের শিকার হন। অন্য সময়ের চেয়ে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বাড়ে। এজন্য সফরে সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে, কোনোভাবেই অসতর্কভাবে চলাফেরা করা যাবে না। যে কয়দিন গ্রামে থাকবেন, অযথা অপ্রয়োজনে রোদে এবং অন্য কোথাও বেশি ঘোরাফেরা করবেন না। এ সময় সাপের কামড়ের রোগীরও প্রচুর খবর পাওয়া যায়। বাচ্চাদের দিকে বেশি নজর রাখবেন যেন পুকুর, নদী বা জলাশয়ের পানিতে বাচ্চারা একা একা না নামে। মনে রাখবেন- ঈদের আনন্দ যেন দুঃখ বয়ে না আনে, ঈদযাত্রা যেন পরিণত না হয় বিষাদময় কোনো ঘটনায়, সেদিকেও সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে। এ সময় নিজের ও অন্যদের প্রতি সর্বোচ্চ যত্নবান ও সতর্ক থাকলেই ঈদ আনন্দটি সার্থক হতে পারে।

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ: ইমেরিটাস প্রফেসর ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাস
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আরও একজন গ্রেপ্তার
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানে সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আরও একজন গ্রেপ্তার
বনানীতে পথশিশু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা