রাসেলস ভাইপার মারবেন না, ৩৩৩ নম্বরে জানান

সাপ একটি নিরীহ প্রাণী। ছোবল দিতে পারে এমন ভয়েই সাপ দেখা মাত্র মানুষ মারতে উদ্যত হয়। পৃথিবীতে ৪ হাজার ৭৩ প্রজাতির সাপ আছে। বাস্তবতা হচ্ছে এর মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ সাপ বিষধর। বাকি সবই নির্বিষ। আর বাংলাদেশে ২ প্রজাতির গোখরো, ৫ প্রজাতির কেউটে এবং ভাইপার প্রজাতির রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং এদের মধ্যে ছয় হাজার মানুষ মারা যান। অত্যন্ত বিষধর প্রজাতির রাসেলস ভাইপার সাপ বাংলাদেশ থেকে বহু আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে এর অবাধ বিচরণ ভাবিয়ে তুলছে বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ভয়ঙ্কর রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। রাসেল ভাইপার নামক বিষধর সাপের আক্রমণে আতঙ্কে দিন পার করছেন জনসাধারণ। দেশের চরাঞ্চল এবং নদীর তীরবর্তী লোকালয়ে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বৃদ্ধি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও কৃষির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক।
২০২০ সালের বর্ষাকালে করোনা মহামারির মধ্যেই রাজশাহী-পাবনায় হঠাৎ করেই রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বেড়ে যায়। পদ্মার চরের ফসলের মাঠ, ঝোপঝাড় এমনকি বসতবাড়িতেও ব্যাপকহারে দেখা যায় সাপটিকে। এতে জেলা জুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। সাপের কামড়ে প্রাণও হারান অনেকে।
মানিকগঞ্জে গত তিন মাসে সাপটির কামড়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত পাঁচজন। ঢাকার সীমান্ত জেলা ফরিদপুরের পদ্মার তীর ও আড়িয়াল খাঁ চরাঞ্চলে গত ছয় মাসে সাপটির কামড়ে দুই শিশুসহ পাঁচ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে জেলা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চাষিরা ভয়ে জমিতে যেতে চাচ্ছেন না। এছাড়া দেশের সর্বদক্ষিণের দ্বীপ উপজেলা ভোলার বিভিন্ন এলাকা থেকে গত পাঁচ দিনে উদ্ধার করা হয়েছে ১২টি রাসেলস ভাইপার। আতঙ্কিত এলাকাবাসী ১১টি সাপকেই মেরে ফেলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে রাসেলস ভাইপার সাপ মারতে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে হত্যা করা হচ্ছে রাসেলস ভাইপার। তবে রাসেলস ভাইপার সাপ মারা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করুন বা নিকটস্থ বন বিভাগের অফিসকে অবহিত করুন। এছাড়া সাপ মারা দণ্ডনীয় অপরাধ, সাপ মারা হতে বিরত থাকুন।
রাসেলস ভাইপার বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত প্রাণী। এ সাপ ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সাপের বিষ হতে অনেক জীবন রক্ষাকারী ঔষধ তৈরি হয়।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্ক নয়, বাড়াতে হবে সাবধানতা ও সচেতনতা। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম আছে।
রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের সাথে এই সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সাপ সাধারণত নীচুভূমির ঘাসবন, ঝোঁপজঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সাথে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে। রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই, সকলকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।
সাপের কামড় এড়াতে করণীয়
যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার দেখা গিয়েছে, সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন।
লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড়, কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন। গর্তের মধ্যে হাত-পা ঢুকাবেন না।
সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাজ করার সময় বুট এবং লম্বা প্যান্ট পরুন।
রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট ব্যবহার করুন।
বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত রাখুন।
পতিত গাছ, জ্বালানি লাকড়ি, খড় সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।
সাপ দেখলে তা ধরা বা মারার চেষ্টা করবেন না।
প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করুন বা নিকটস্থ বন বিভাগের অফিসকে অবহিত করুন।
সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে করণীয়
দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া করা যাবে না। পায়ে দংশনে- বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশনে- হাত নড়াচড়া করা যাবে না। হাত পায়ের গিরা নাড়াচাড়ায় মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া করতে পারে।
আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে।
ঘড়ি বা অলঙ্কার বা তাবিজ, তাগা ইত্যাদি থাকলে খুলে ফেলুন।
দংশিত স্থানে কাটবেন না, সুঁই ফোটাবেন না, কিংবা কোনো রকম প্রলেপ লাগাবেন না বা অন্য কিছু প্রয়োগ করা উচিত নয়।
সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান।
আতঙ্কিত হবেন না, রাসেলস ভাইপারের বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম আছে এবং সব জায়গায় হাসপাতালগুলোয় অ্যান্টিভেনম রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাসেলস ভাইপারের প্রাদুর্ভাব কমাতে করণীয়
বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদন টাক এবং কিছু প্রজাতির সাপ রাসেলস ভাইপার খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ সকল বন্যপ্রাণীকে মানুষের নির্বিচারে হত্যার কারণে প্রকৃতিতে রাসেলস ভাইপার বেড়ে যাচ্ছে। তাই বন্যপ্রাণী দেখলেই অকারণে তা হত্যা, এদের আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকুন।
(ঢাকাটাইমস/২৪ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন