মৃত্যুকালে শাহজাহানের পাশে ছিল না কোনো স্বজন, হাসপাতালে নেন বাড়িওয়ালা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিসহ প্রায় ২৬ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা আলোচিত ‘জল্লাদ’ শাহজাহান ভূঁইয়া (৭৪) মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সোমবার ভোরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে বুধবার রাতে বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে।
খবরটি নিশ্চিত করেছেন শাহজাহানের বোন ফিরোজা বেগম। তিনি জানান, সাভারে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন শাহজাহান। রবিবার দিনগত রাত ৩টার দিকে হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর ৫টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. আহাদ আলী জানান, জল্লাদ শাহজাহান সর্বশেষ সাভারের হেমায়েতপুরে থাকতেন। রাতে বুকে ব্যথা শুরু হলে তার বাসার বাড়িওয়ালা কাশেম তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
জল্লাদ শাহজাহানের মরদেহ হাসপাতালে রাখা হয়েছে। তার আত্মীয়দের খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান ওসি।
কারা সূত্রে জানা যায়, জল্লাদ শাহজাহান ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৬ জনের ফাঁসি দিয়েছেন। এর মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, চারজন যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গি নেতা বাংলাভাইসহ দুজন জেএমবি সদস্য এবং আরও ১৪ জন অন্যান্য আলোচিত মামলার আসামি।
জানা যায়, ১৯৯১ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৩৬টি মামলায় শাহজাহানের ১৪৩ বছরের সাজা হয়। পরে ৮৭ বছরের সাজা মাফ করে তাকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফাঁসি কার্যকর ও সশ্রম কারাদণ্ডের সুবিধার কারণে সেই সাজা ৪৩ বছরে এসে নামে।
দুটি মামলায় ৫ হাজার টাকা করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাস করে অতিরিক্ত এক বছর জেল খেটে ৩২ বছর পর গত বছরের ১৮ জুন কারাগার থেকে মুক্তি পান শাহজাহান।
সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে শাহজাহান তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর কারাগারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় এলেই ডাক পড়তো তার। টানা আট বছর এই কাজ করার পর কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেয়।
মুক্ত হয়ে সংসার পেতেছিলেন জল্লাদ শাহজাহান, টেকেনি দেড় মাসও
জেলখানা থেকে বের হয়ে চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এর মধ্যে একদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে কোনাখোলা এলাকায় যাওয়ার পথে অটোরিকশায় একটি ভ্যানিটি ব্যাগ পান। ব্যাগের ভেতরে একটি কাগজে গ্রামীণফোনের নম্বর লেখা ছিল।
প্রকৃত মালিককে ব্যাগ ফেরত দেওয়ার জন্য তিনি ওই নম্বরে ফোন করলে সাথী আক্তার ফাতেমা নামে এক নারী রিসিভ করেন এবং ব্যাগটি তার বলে জানান। এরপর সাথীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে শাহজাহানের। একপর্যায়ে গত ২১ ডিসেম্বর শাহজাহান ও সাথীর বিয়ে হয়।
বিয়ের পরই তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। এর মধ্যে শাহজাহানের কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কারসহ ১৩ লাখ টাকা নিয়ে যায় সাথী। শুধু টাকা নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি সে। শাহজাহানের বিরুদ্ধে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যৌতুক আইনে ঢাকার আদালতে একটি মামলা করে সে। মামলাটি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
অন্যদিকে শাহজাহান বাদী হয়ে গত ৩১ মার্চ সাথীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।
শাহজাহানের করা মামলা থেকে জানা যায়, ৪৪ বছর কারাবাসের পর গত বছরের ১৮ জুন মুক্তি পান। বাদীর আত্মীয়স্বজন বা আপনজন বলতে কেউ নেই, এমনকি বসতভিটাও ছিল না। যার কারণে অসহায় বাদী ঢাকার বাবুবাজারে একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন। কারাগারে থাকাবস্থায় পরিচিত রাকিব নামের একজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। রাকিবের কাছে তিনি তার অসহায়ত্বের বিস্তারিত বলেন। পরে রাকিব তার অফিসে ১৫ দিনের মতো থাকার ব্যবস্থা করেন। এরপর রাকিবের সহায়তায় বাদী দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
অন্যদিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৫ লাখ টাকা অনুদান পান শাহজাহান । নরসিংদীর সোনালী ব্যাংক লিমিটেড পলাশ শাখা থেকে উত্তোলন করেন এই টাকা। এছাড়া জেলখানায় থাকাবস্থায় যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাদের অনেকেই তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। সবমিলিয়ে তিনি আর্থিকভাবে প্রায় ১৮ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন।
(ঢাকাটাইমস/২৪জুন/এলএম)

মন্তব্য করুন