বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য, দিশেহারা রোগী

এস এম আব্দুল মান্নান, সিরাজগঞ্জ
  প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১৪:৩৯| আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১৪:৫২
অ- অ+

সিরাজগঞ্জের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। ফলে অনিয়ম আর দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগী। দালালদের খপ্পরে পড়ে তারা প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। হাসপাতালটির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রোগীদের।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই সিরাজগঞ্জ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে দালালদের এমন দৌরাত্ম্য চলছে। তারা হাসপাতালের কাছাকাছি ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিকের প্রভাবশালীদের নিয়োগপ্রাপ্ত। এই মালিকদের মধ্যে কেউ আবার হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা স্থানীয় হওয়ায় তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণেই হাসপাতালে চলছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রমরমা ব্যবসা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক মালিকদের নিয়োগকৃত দালালরা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের আউটডোরসহ ভেতরে ও বাইরে বিচরণ করেন। কোনো নতুন রোগী ও স্বজনদের দেখলেই পিছু নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলে নিয়ে যান কন্ট্রাক্ট করা চিকিৎসকের কাছে। ওই চিকিৎসকরা অনেক টেস্ট লিখে প্রেসক্রিপশন দালালদের হাতে ধরিয়ে দেন। ফলে দালালদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে কয়েক হাজার টাকার টেস্ট করাতে বাধ্য করা হয় রোগীদের। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।

এদের বিষয়ে বরাবরই চুপ থাকেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের কর্মকর্তারা। শত অভিযোগ পেলেও টনক নড়ে না তাদের।

হাসপাতালে এসে দালালের খপ্পরে পরা একাধিক ভুক্তভোগী নজরুল ইসলাম,হিলটন ফকির, আলী আশরাফ,শাহিন মিয়া,শাহিদা আক্তার মিলু,মরিয়মসহ একাধিক রোগী অভিযোগ করে বলেন, ‘হাসপাতালে রোগী ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের কীভাবে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাবে টেস্ট করানোর জন্য, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঘোরাঘুরি করা দালাল ও হাসপাতালের কর্মচারীরা। প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠালেই তাদের কমিশন নির্ধারিত। টেস্ট প্রতি হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩০-৪০ শতাংশ।

আবার চিকিৎসকরা তাদের পাঠানো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টেস্ট রিপোর্ট না পেলে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন রোগীরা। তাই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালটি দালালমুক্ত দেখতে চান চিকিৎসা নিতে আসা শতশত অসহায় মানুষ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক জানান, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিকের মালিকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক দালালদের। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের কিছু চিকিৎসকই তাদের পেলেপুষে রাখেন। ফলে কীভাবে দালালমুক্ত হবে হাসপাতাল? এখানে যতদিন পর্যন্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক মালিকদের আধিপত্য থাকবে, ততদিন হাসপাতাল থেকে দালাল নির্মূল করা সম্ভব হবে না।

এ ব্যাপারে জানতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ফরিদুল ইসলামকে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ফোন রিসি়ভ করেননি।

তবে কথা হয়েছে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতন কুমার রায়ের সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘হাসপাতালে দালাল আছে। আমরা মাসিক মিটিংয়ে এ বিষয়ে আলাপ করেছি, কীভাবে হাসপাতালকে দালালমুক্ত করা যায়। সেখানে সদর আসনের এমপি মহোদয় উপস্থিত ছিলেন। সদর থানার ওসিও ছিলেন। আমরা প্রশাসনের কাছে তালিকা দিয়েছি। এখন প্রশাসন যদি না ধরে আমরা কী করবো?’

তার দাবি, ‘আমরা কিছু বলতে গেলে আমাদের সঙ্গে অনেক ঝামেলা হয়। কারণ দালাল এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা স্থানীয়।

ডা. রতন কুমার রায় আর ও বলেন, ‘দালালদের সঙ্গে যদি আমাদের কোনো স্টাফ যুক্ত থাকেন, এমন প্রমাণ যদি কেউ দিতে পারেন, তবে ওই স্টাফের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করবো।’

ডাক্তাররা তাদের পছন্দের ডায়গোনস্টিক সেন্টারে সাধারণ জনগণকে অতিরিক্ত টেস্ট দিয়ে কমিশন খায়- এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. রতন কুমার রায়ের বলেন, ‘এখন কোনো ডাক্তার আর এই কাজ করে না। আমি নিজে সকল ডাক্তারকে চিঠি দিয়েছি। তবে সাবেক এমপি মহোদয়ের সময়ে আমাদের একজন ডাক্তার আলতাব হোসেনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছিল। যখন তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব তখন তিনি আমাদের কাছে ভুল স্বীকার করেন এবং এমপি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করে নেন। এখন তার বিরুদ্ধে আর এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। যদি কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া যায় তবে তার বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেব। হাসপাতাল থেকে দালাল নির্মূল করতে আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আমাদের কাজ না, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজ। সেই সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। এর আগে একটা ফোন চোরকে ধরে চালান করে দিয়েছিলাম। তারা বের হয়ে আবার চুরি করে। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করবো। তারা নাম দিলেই আমরা ধরতে পারি না। তারা দালাল ধরে আমাদের ফোন করবে, তখন আমরা তাদেরকে ধরে নিয়ে এসে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি।’

সিরাজগঞ্জ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সিভিল সার্জন ডা. রাম পদ রায় বলেন, ‘আমি এই প্রথম শুনলাম। এর আগে কখনো শুনিনি, আমাকে কেউ কখনো বলেওনি। এ বিষয়ে আমি হাসপাতালের প্রধান ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে কথা বলবো। মাসিক মিটিংয়েও আলোচনা করব। যদি সত্যতা পাই তাহলে ব্যবস্থা নেব।’

সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক মীর মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি জেনে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেব।’

অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের নবনির্বাচিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয়ের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।

জেলার সচেতন মহলের দাবি, দালাল নির্মূল করতে হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কমিশন খাওয়া বন্ধ করতে হবে এবং হাসপাতাল প্রধানদের আরও সচেতন হবে। সেই সঙ্গে প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে।

সিরাজগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, ‘১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আমরা যুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি। এই স্বাধীন দেশে মানুষ সরকারি হাসপাতালে যাবে, ভালো চিকিৎসা পাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি, যেন সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে এসে কোনো দালালের খপ্পরে না পড়ে। দালালমুক্ত হবে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও যদি শুনতে হয় যে, সরকারি হাসপাতালে দালাল আছে, তবে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।’

(ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/এজে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
রাজবাড়ীতে ডেকে নিয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেপ্তার ৪
আজ সরকারি অফিস-ব্যাংক-পুঁজিবাজার খোলা
মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ড
হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গেছেন ৪৮ হাজার ৬৬১ বাংলাদেশি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা