আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে

মোরশেদুল জাহের, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২৪, ১৪:৪৯ | প্রকাশিত : ১২ আগস্ট ২০২৪, ১০:৫৮

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভয়াবহ বিপর্যায়ে পড়া আওয়ামী লীগের সামনে কী অপেক্ষা করছে? ভবিষ্যতে এর সাংগঠনিক অবস্থাই বা কী হবে? পুরনো নেতৃত্ব কি হাল ধরবে, নাকি আসবে নতুন কেউ? এমনই আলোচনা আছে মানুষের মাঝে।

গত ৫ আগস্ট দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এক অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। বর্তমানে ভারতে অবস্থান করা শেখ হাসিনা অন্য কোনো দেশে যাবেন কি না এখনো নিশ্চিত নয়। তবে তিনি তৃতীয় কোনো দেশে না যাওয়া পর্যন্ত ভারতেই তার থাকার ব্যবস্থা করেছে দেশটির সরকার।

এদিকে ওই দিন থেকেই পলাতক দলের গুরুত্বপূর্ণ সব নেতা। দলের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতার কোনো হদিস নেই কোথাও। কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কেউবা দেশেই আত্মগোপন করে আছেন। কয়েকজন নেতা পালাতে গিয়ে আটক হয়েছেন। তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার, কেউ কেউ আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছেন, কিন্তু সেখানেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা কেউ সামনে নেই এখনো।

সাংগঠনিকভাবে ভয়াবহ নাজুক আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা এখন অভিভাবকহীন। এই অবস্থায় কেউ কথা বলতেও ভয় পান। শীর্ষ ও বহুল পরিচিত নেতারা সামনে আসছেন না। বরং আলোচনায় ছিলেন না, এমন কোনো কোনো নেতা একটু আওয়াজ দিচ্ছেন। আগামী দিনে দল বাঁচাতে সামনে আসবেন তারা, এমনটাই ভাবছেন অনেক নেতাকর্মী।

আবার শেখ হাসিনা যেসব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে তার কমিটিতে রাখেননি, এই দুর্দিনে তারাও সামনে আসতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রাচীনতম দলটির সাংগঠনিক কাঠামোতে আসতে পারে ব্যাপক পরিবর্তন।

গত ১৫ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটির সিনিয়র ও তৃণমূলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

এর আগেও একাধিকার দেখা গেছে, দলের দুর্দিনে এমন কেউ এসে হাল ধরেছেন, যাদের প্রতি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবহেলা দেখিয়েছেন। কিংবা কখনো আলোচনায় ছিলেন না। ৭৫-পরবর্তী ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময় দলের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর অবহেলার শিকার হয়ে তার মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তাজউদ্দিন।

এই তাজউদ্দীন আহমদই বাংলাদেশের ঘোর দুর্দিনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তার হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব দেন। আর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে এবং ৩ নভেম্বর জেলখানায় তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বশূন্য আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন অনভিজ্ঞ জোহরা তাজউদ্দীন। ১৯৭৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। দলকে পুনর্গঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন। দলের দিগভ্রান্ত নেতা-কর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে সফর করেন সারা দেশ। সেবার দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে।

এরপর ২০২৪ সালের আগ পর্যন্ত এত বড় বিপর্যয়ে আর পড়েনি আওয়ামী লীগ। তবে ২০০৭ সালে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের মাইনাস টু ফর্মুলার শিকার হতে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তাকে জেলে পুরে সরকার। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন প্রায় অবসরে যাওয়া প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমান। সরকারের ভয়-ভীতি আর প্রলোভনে যখন অনেক শীর্ষ নেতা দিগভ্রান্ত, তখন দলকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি।

জিল্লুর রহমানের অবদানের কথা স্বীকার করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক-এগারোর চরম দুঃসময়ে জিল্লুর রহমান দলের হাল ধরেছিলেন, তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ আমাকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে এনেছিল।’

সেবারও দলের নেতৃত্বে অনেক নতুন মুখ সামনে এসেছে, যারা এর আগে প্রায় অপরিচিত ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে।

১৭ বছর পর এবার মহাবিপর্যয়ের মুখে আওয়ামী লীগ। জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালান। পালিয়েছেন দলের প্রায় সব নেতা। এর পরপরই এক ভিডিওবার্তায় হতাশার কথা শোনান তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। বলেছিলেন, তার মা কিংবা শেখ পরিবারের আর রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা নেই।

তবে দুদিন পরই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই তথ্য উপদেষ্টা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাতে তিনি (জয়) রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের বাঁচাতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। জয়ের ভাষ্য, ‘আমার কখনো রাজনীতিতে আসার পরকল্পনা ছিল না। আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করি। আমার মায়েরও এবার রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর যেভাবে হামলা করা হচ্ছে, তাতে আমাকে সম্মুখ সারিতে আসতে হচ্ছে।..আমি বিশ্বাস করি দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এবং বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করতে পারে।’

একই সঙ্গে জয় এও জানান, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া মাত্রই শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন।

তারও দুদিন পর শেখ হাসিনা দলের কর্মীদের উদ্দেশে একটি বার্তা পাঠান। দেশ থেকে পালানোর পর প্রথম নীরবতা ভাঙেন তিনি। শনিবার দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ওই বার্তায় বলেন, লাশের মিছিল যাতে দেখতে না হয়, সে জন্য তিনি পদত্যাগ করেছেন। তিনি শিগগিরই দেশে ফিরবেন। যেসব কর্মী দেশে আছেন, তারা কেউ যেন মনোবল না হারায়। আওয়ামী লীগ বারবারই উঠে দাঁড়িয়েছে।

শেখ হাসিনার বার্তা থেকে পরিষ্কার- তিনি নিজেও জানেন তার দলের বেশির ভাগ নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো শীর্ষ পর্যায়ের কেউ নেই দেশে। তাই তাদের বাইরে থেকেই দলের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

শেখ হাসিনা সরকারের শেষ মেয়াদে অনেকটা উপেক্ষার শিকার দুজন প্রবীণ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সব বিপর্যয়ের সময় বরাবর অবহেলিত নেতা-কর্মীরা দলকে আঁকড়ে ধরেছেন। তারাই টেনে তোলেন দলকে। এবারও তাই হবে।

অভিজ্ঞতা থেকে তারা বলছেন, দলের পুনর্গঠনে এবার সাংগঠনিক কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। জয় নেতৃত্বের সামনে আসবেন বললেও তারা খুব বেশি ভরসা রাখতে পারছেন না। কেননা জয় তার প্রথম বার্তায় বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, সেটা আমার চিন্তার বিষয় না, আমার পরিবারেরও বিষয় না। আপনারা বুঝবেন।’ পরদিন ৬ আগস্ট বিবিসিকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা রাজনীতিতে ফিরবেন না। আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি– আমাদের যথেষ্ট হয়েছে।’ ৭ আগস্ট পুরো ঘুরে গিয়ে বলেন, ‘আপনারা একা না। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। বঙ্গবন্ধুর পরিবার কোথাও যায়নি। নেতাকর্মী ও আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য যা করা প্রয়োজন আমরা করতে প্রস্তুত।’

অর্থাৎ বিদেশে বড় হওয়া ও বিদেশী জীবনে অভ্যস্ত জয় এখনো সুস্থির নন, তিনি কী করতে চান। জয় বাংলাদেশের মতো একটি দেশের রাজনীতির চ্যালেঞ্জ নিতে আসবেন, এটা তারা আস্থায় নিতে পারছেন না। এ ছাড়া গত ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনাও রাজনীতিতে জয়কে তেমন একটা সম্পৃক্ত করেননি।

এ ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকে, শেখ হাসিনা কবে দেশে ফিরবেন, এর মধ্যে দল ও দলের নেতাকর্মীদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, সেটি অনুমান করা গেলেও পরিষ্কার নয়। তাই প্রবীণ ও তৃণমূলের কর্মীদের ধারণা, দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে এমন নেতারাই আসবেন, যারা এত দিন তেমন আলোচনায় ছিলেন না।

আবার কেউ কেউ বলছেন, শেখ হাসিনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকেও দলে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন, বা কোনো পদ-পদবি দেননি সরকার কিংবা কমিটিতে। দলের এই ক্রান্তিলগ্নে তারা সামনে আসতে পারেন দলকে টিকিয়ে রাখতে।

গত ১৫ বছর যারা দল ও ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি ছিলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে গড়েছেন বিপুল বিত্তবৈভব, দলের সাংগঠনিক কাজ থেকে ছিলেন দূরে, তাদের অনেকে ইতিমধ্যে বিদেশে স্থায়ী আবাস গড়েছেন। তাদের বেশির ভাগকে আর দলে তেমন দেখা যাবে না- নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন প্রবীণ নেতারা।

(ঢাকা টাইমস/১২আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :