বন্যায় সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকার উপায়, জেনে নিন

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ২২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১৮| আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৪৭
অ- অ+

নদীমাতৃক বাংলাদেশে পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গোমতীসহ ছোট-বড় অসংখ্য নদনদী ঘিরে রেখেছে। এসব নদনদী তাদের অকৃপণ দানে এদেশের মাটি ও মানুষকে যেমন করেছে সমৃদ্ধ, তেমনি প্রকৃতির নিয়মে মাঝে মাঝে এরা মেতে ওঠে মরণ খেলায়। প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ধ্বংস করে দেয় লোকালয়, বিনষ্ট করে সম্পদ, অসংখ্য মানুষকে টেনে নিয়ে যায় অবর্ণনীয় দুর্দশার দ্বারপ্রান্তে। বাংলার মানুষ এর আগেও কয়েকবার ভয়াবহ বন্যার সাক্ষী হয়েছে। অতীতে বন্যা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ সালে। জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এই বন্যাগুলোতে।

ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় উৎকণ্ঠার মাঝে রয়েছেন নদীর চরাঞ্চলের কৃষকসহ সাধারণ মানুষ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় চর ডুবে যাওয়ায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নিচু এলাকার বাড়িঘরে প্রবেশ করছে পানি। বিভিন্ন জায়গায় গোমতীর আইলে ফাটল দেখা দিচ্ছে। এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে উত্তেজিত না হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কিছু বিষয় অনুসরণ করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। জেনে নিন করণীয়-

প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে বন্যার পানি আপনার বাড়ির কাছাকাছি আসার আগেই আশ্রয় কেন্দ্র বা নিরাপদ উঁচু কোনো স্থানে চলে যাওয়া। বন্যার পানি বেড়ে গেলে দ্রুত পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে আশ্রয় স্থানের সন্ধান খুঁজুন। দরকার পড়লে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে কোনো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করুন। একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। এই পরিস্থিতিতে সকলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করুন। তাছাড়া আশ্রয় স্থানের জন্য স্থানীয় জরুরী ব্যবস্থাপনা অফিস, পরিকল্পনা ও জোনিং বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। এই সমন্বয়কদের মনোনীত আশ্রয়কেন্দ্র থাকবে, যেমন- স্কুল বা স্টেডিয়াম। সেসব স্থানে আশ্রয় নেয়া যাবে কিনা খোঁজ রাখুন।

আগে থেকেই বাড়ির ভিটা, নলকূপ, টয়লেট যত দূর সম্ভব উঁচু করতে হবে। এক্ষেত্রে অতীতের বন্যার পানির উচ্চতার মাত্রা মনে রাখতে হবে।

বন্যা পরিস্থিতিতে বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যতিত কীভাবে আলোর ব্যবস্থা করা যায় তা নিশ্চিত করুন। তবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- প্রধান পাওয়ার সুইচের ইউটিলিটিগুলো বন্ধ করে দেয়া। কারণ বৈদুতিক সংযোগ পানির সংস্পর্শে আসলেই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বন্যার পানি বাড়তে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব ঘরে থাকা মূল্যবান জিনিসগুলো নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিন। আপনার গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো প্লাস্টিকের ফোল্ডারে রাখার চেষ্টা করুন। এছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিশেষ করে টাকা-পয়সা, জমির দলিল, শিক্ষা সনদ নিরাপদ স্থানে রাখুন। পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধন, ব্যাংকের কাগজপত্র, নগদ অর্থ পানিরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে পারেন।

শুকনো খাবার বিশেষ করে মুড়ি, চিড়া, গুড়, চিনি সংরক্ষণ করতে হবে। বিশুদ্ধ খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য চৌবাচ্চার ব্যবস্থা করতে হবে।

সহজে বহনযোগ্য চুলা ও রান্না করার জন্য শুকনো জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে। পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সংরক্ষণ করতে হবে।

বৃদ্ধ, শিশু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও গর্ভবতী নারীর ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের দিকে। অনেকসময় শিশুরা পানিতে নেমে যায় খেলতে, এতে বড় কোনো বিপদ হতে পারে।

মাথা ঠান্ডা করে একটি ব্যাগ গুছিয়ে রাখুন। যেখানে কমপক্ষে তিন দিনের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও পানি নিন। প্রত্যেকের জন্য একটি করে পোশাক, প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখুন।

এসময় উচু স্থান দেখে কোনো ব্রিজে আশ্রয় নেবেন না। কারণ বন্যার পানি সেতুর উপর দিয়েও প্রবাহিত হতে পারে।

বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র পরিদর্শন করার আগে পাওয়ার চালু করবেন না।

সাপ ও বিভিন্ন প্রাণী আপনার বাড়িতে থাকতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন। সম্ভব হলে গ্লাভস ও বুট পরুন।

বন্যায় ডায়রিয়া প্রতিরোধে খাওয়ার আগে এবং পায়খানা করার পর হাত ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে। ডায়রিয়া শুরু হলে পরিমাণমতো খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে। দুই বছরের কম শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০-১২ চা চামচ এবং ২ থেকে ১০ বছরের শিশুকে ২০ থেকে ৪০ চা চামচ খাওয়ার স্যালাইন দিতে হবে। খাওয়ার স্যালাইন না থাকলে বিকল্প হিসেবে লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে।

পাশাপাশি ভাতের মাড়, চিঁড়ার পানি, ডাবের পানি, কিছু পাওয়া না গেলে শুধু নিরাপদ পানি খাওয়ানো যেতে পারে। এ সময় শিশুর পুষ্টিহীনতা রোধে খিচুড়ি খাওয়ানো যেতে পারে। ভিটামিন `এ` ক্যাপসুলও খাওয়ানো যেতে পারে। যদি পাতলা পায়খানা ও বমির মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

বন্যায় সময় পচা-বাসি খাবার খেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। ফলে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ। খিচুড়ি খাওয়া এ সময় স্বাস্থ্যোপযোগী। খাবার প্লেট সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। পানি বেশি খরচ হয় বলে অনেকে প্রথমে একবার স্বাভাবিক পানিতে থালাবাসন ধুয়ে তারপর ফুটানো পানিতে ধুয়ে নেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এতে থালাবাসনে অনেক ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে।

বন্যার সময় যেখানে-সেখানে মলত্যাগ করা উচিত নয়। এতে পেটের পীড়া ও কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে হবে এবং মলত্যাগের পরে সাবান বা ছাই দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মলত্যাগের সময় কখনো খালি পায়ে থাকলে বক্রকৃমির জীবাণু শরীরে সংক্রমিত হয়। এ সময় বাসার সবাইকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত। তবে দুই বছর বয়সের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

বন্যার দূষিত পানি পান করা যাবে না। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ফিটকিরি ব্যবহার করে পানি পান করতে হবে। বন্যার পানিতে গোসল করা, জামা-কাপড় ধোয়া যাবে না।

বন্যার সময় পানির উৎস হওয়ায় তা ভালোমতো ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করাসহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করতে হবে। বন্যার পানিতে টিউবওয়েল তলিয়ে গেলে এক কলস পানিতে তিন-চার চা চামচ ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে টিউবওয়েলের ভেতর এই পানি ঢেলে দিন। এবার আধা ঘণ্টা রেখে এরপর একটানা আধা ঘণ্টা চেপে পানি বের করে ফেলে দিলে সেই পানি খাওয়ার উপযোগী হয়।

আর ব্লিচিং পাউডার না থাকলে এক ঘণ্টা টিউবওয়েলের পানি চেপে বের করে ফেলতে হবে। তবে নিরাপত্তার জন্য টিউবওয়েলের পানিও ভালোমতো ফুটিয়ে নেওয়া উচিত। এবং পানি একটানা ৩০ মিনিট ফুটিয়ে তারপর ঠাণ্ডা করতে হবে।

কিন্তু পানি ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে প্রতি দেড় লিটার খাওয়ার পানিতে ৭.৫ মিলিগ্রাম হ্যালোজেন ট্যাবলেট (হ্যালো ট্যাব), তিন লিটার পানিতে ১৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রেখে দিলে পানি বিশুদ্ধ হয়। আবার বাসার পানির ট্যাংকের প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে ২৫০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার এক ঘণ্টা রাখলে পানি বিশুদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হয় না।

বন্যার দূষিত পানি পানে হতে পারে কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, ডায়রিয়া এবং টাইফয়েডের মতো মারাত্মক পানিবাহিত রোগ। বাড়ে মৃত্যুঝুঁকি। তাই প্রয়োজন বিশুদ্ধ পানি পান করা। পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। উচ্চতাপে ১০/২০ মিনিট পানি ভালোভাবে ফুটাতে হবে। ফলে পানিতে থাকা রোগজীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়, ধাতব লবণ থিতিয়ে পড়ে ও দ্রবীভূত গ্যাস বের হয়ে যায়। পানির সর্বোচ্চ বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য ফুটানোর পরে ফিল্টার ব্যবহার করতে হবে। বন্যার সময় পানি ফুটানোর পরে নিঃসন্দেহে ফুটানো পানি পান করা যাবে। তবে মনে রাখতে হবে বেশি পানি ফুটালে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ বেড়ে যায়।

বৃষ্টির পানির গুণমান উন্নত করতে দুটি কাজ করতে পারেন। বৃষ্টির পানি ফুটিয়ে নেওয়া বা পানি ফিল্টার করে পান করা। পানি ফুটানো হলে প্যাথোজেনগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ফিল্টারের ফলে ধূলিকণাসহ অন্যান্য দূষকগুলো দূর হয়ে যাবে। বৃষ্টির পানি কীভাবে সংগ্রহ করছেন তার ওপরও পানির মান নির্ভর করে। আকাশ থেকে সরাসরি বৃষ্টির পানি পরিষ্কার বালতি বা বাটিতে সংগ্রহ করতে পারেন। বৃষ্টি শুরু হওয়ার ১০ মিনিট পর থেকে পরিষ্কার পাত্রে পানি সংগ্রহ করে রাখলে পানি পানের উপযোগী হয়।

বন্যার সময় আকস্মিক নানা দুর্ঘটনা ঘটে। সাধারণত বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপ ও পোকামাকড়ের কামড়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে বা পানিতে পড়ে থাকতে দেখলে তা স্পর্শ না করে বিদ্যুৎকর্মীদের জরুরিভাবে খবর দিতে হবে। সাপ ও ইঁদুর তাদের আবাস হারিয়ে শুকনো স্থানে মানুষ ও গবাদি পশুপাখির সঙ্গে অবস্থান নেয়। এ জন্য সাপ ও ইঁদুরে কাটার পরিমাণ বেড়ে যায়। বিষহীন সাপে কাটলে ভয়ের কিছু নেই। তবে বিষধর সাপে কাটলে সাপে কাটা স্থানের সামনে মোটা কাপড় বা গামছা বা রশি দিয়ে দিয়ে গিঁট দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে অ্যান্টিভেনম এবং টিটেনাস প্রতিষেধক দিতে হবে। ইঁদুরে কাটলেও অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/২২ আগস্ট/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ঢাকাসহ দেশের ১০ অঞ্চলে ঝড়ের আভাস, নদীবন্দরে সতর্ক সংকেত
কিডনি সুস্থ রাখতে কোন কোন তেল খাবেন, জানুন প্রতিদিন কতটুকু তেল খাবেন
গাজায় ৪৮ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ৭৭ জন নিহত
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে যে নিয়মে আম খেলে
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা