ডায়রিয়ায় সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকার উপায়, জেনে নিন

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৯

বাংলাদেশে বন্যার পর উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, পেটের পীড়ার প্রকোপ। বন্যার পানি ও শিল্পকারখানার বর্জ্যের সঙ্গে মিশ্রিত পানি সৃষ্টি করছে অস্বাস্থ্যকর বিপজ্জনক পরিবেশ। এতে করে বেশির ভাগ আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়।

দিনে তিনবারের বেশি পাতলা পায়খানা হলে ধরে নিতে হবে ডায়রিয়ার লক্ষণ। ডায়রিয়া হলে শরীর প্রচন্ড দুর্বল হয়ে যায়। কারণ, পাতলা পায়খানার সাথে প্রচুর পরিমাণ পানি ও লবণজাতীয় পদার্থ বের হয়ে যায়। এতে শরীরে লবণের ঘাটতি ও পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। সময়মতো এসব ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে মৃত্যুও হতে পারে।

সাধারণত অন্ত্রে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে ডায়রিয়া দেখা দেয়। আর ডায়রিয়ার জীবাণু দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের পেটে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির মল থেকে ডায়রিয়ার জীবাণুগুলো হাতের মাধ্যমে, তেলাপোকা বা মাছির মাধ্যমে, এমনকি অনেক সময় সরাসরি খাদ্য ও পানিতে সংক্রমিত হয়। এই দূষিত পানি বা খাদ্য গ্রহণ করলে অন্যরাও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ডায়রিয়ার মূল চিকিৎসা হলো শরীরে যে পানিস্বল্পতা ও লবণের ঘাটতি দেখা দেয়, তা পূরণ করাই এই সমস্যা সমাধান। পানিস্বল্পতা দূর করতে বেশি বেশি নিয়ম মেনে খাওয়ার স্যালাইন পান করতে হবে।

বেশি মাত্রায় ডায়রিয়া হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কারণ রোগীকে শিরা পথে স্যালাইন ও অ্যান্টবায়োটিক দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবে নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া ঠিক হবে না। লোপিরামাইড জাতীয় ওষুধ খাবেন না। ওরস্যালাইনের পাশাপাশি রোগীকে সব ধরনের স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে। সেই সাথে ডাবের পানি ও যেকোনো ফলের রস, ভাতের মাড়, চিড়ার পানি, টকদই, মাঠা, লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। প্যাকেটজাত ফলের জুস বেশি খাওয়ানো ঠিক হবে না।

ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিলে আতঙ্কিত হবেন না। এই অসুখ থেকে তাৎক্ষণিক আরোগ্য লাভ করা যায় না। বরং ধীরে ধীরে স্যালাইন ও পথ্য গ্রহণের মাধ্যমে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ডায়রিয়া হলে কিছু করণীয় উল্লেখ করেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক-

এক প্যাকেট স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খাবেন।

বড়দের (দশ বছরের বেশি) ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর এক গ্লাস (২৫০গ্রাম) পানিতে গুলিয়ে খাবেন।

শিশুদের ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর শিশুর যত কেজি ওজন তত চা চামচ বা যতটুকু পায়খানা হয়েছে আনুমানিত ততটুকু স্যালাইন খাওয়াবেন।

শিশুর বমি হলে ধীরে ধীরে খাওয়ান, যেমন প্রতি তিন-চার মিনিট পর পর এক চা চামচ করে স্যালাইন খাইয়ে দিন।

খাবার স্যালাইন খাওয়ানোর পাশাপাশি দুই বছরের নিচের শিশুকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, কোনোভাবেই বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না।

ছয় মাসের অধিক বয়সী রোগী খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি সব ধরনের খাবার খেতে পারবে।

রোগীকে খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি বেশি বেশি তরল খাবার যেমন ডাবের পানি, চিড়ার পানি, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াবেন।

রোগীকে কোমল পানীয়, ফলের রস, আঙুর, বেদানা খাওয়াবেন না।

ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের শিশুকে প্রতিদিন একটি করে জিংক ট্যাবলেট পানিতে গুলিয়ে দশ দিন খাওয়াবেন।

এরপরও রোগীর উন্নতি না হলে বা খারাপ অবস্থা হলে দ্রুত কাছের হাসপাতাল/ স্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইন পাওয়া না গেলে

ডায়রিয়ার জন্য আলাদা কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। পানিশূন্যতা রোধের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ তরলজাতীয় খাবার খেলেই ডায়রিয়া সেরে যায়। আর এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পথ্য হচ্ছে খাবার স্যালাইন।

ডায়রিয়া এবং বমি থেকে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে খাবার স্যালাইন পান করতে হয়। এর উপকারিতা অনেক। শরীরে প্রয়োজনীয় তরল পৌঁছে দিতে সাহায্য করে এই পানীয়।

অনেক সময় জরুরি অবস্থায় প্যাকেটজাত খাবার স্যালাইন হাতের কাছে না-ও পাওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঘরেই স্যালাইন প্রস্তুত করে নেয়া যেতে পারে। এ জন্য লাগবে চিনি, লবণ ও পানি।

৬ চামচ চিনি ও আধা চামচ লবণ ১ লিটার বিশুদ্ধ পানিতে ভালোভাবে গুলে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে স্যালাইন।

সতর্কতা

স্যালাইন তৈরির সময় উপাদানে কম বেশি করা যাবে না। চিনির পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে ডায়রিয়া বেড়ে যেতে পারে, আবার অতিরিক্ত লবণ শিশুর মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তবে হাতে বানানো স্যালাইনের ক্ষেত্রে পানি ১ লিটারের চাইতে সামান্য বেশি ব্যবহার করলেও সমস্যা নেই। আরেকটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, বাজারে অনেক ধরনের ফ্লেভার মিশ্রিত স্যালাইন পাওয়া যায়–তবে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসায় এসব ফ্লেভার মিশ্রিত স্যালাইন বরং ক্ষতিই বেশি করতে পারে।

পর্যাপ্ত তরল খেতে থাকলে, কোনো ওষুধ ছাড়াই ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়। না হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

ডায়রিয়া থেকে বাঁচার উপায়

পানি ফোটানোর সময় বলক ওঠার পর আরও পাঁচ মিনিট চুলায় রাখুন এবং ঠান্ডা করে পান করুন। পানি ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে প্রতি তিন লিটার পানিতে একটি পানি-বিশুদ্ধিকরণ ক্লোরিন ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করে নেওয়া যেতে পারে।

রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর উন্মুক্ত খাবার খাবেন না।

খাবার আগে সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে বিশ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে নেবেন।

পায়খানা করার পর অথবা শিশুর পায়খানা পরিষ্কার করার পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেবেন।

ফিডারে শিশুকে কিছু খাওয়াবেন না। যদি খাওয়াতেই হয় তবে তার আগে ফোটানো পানি ও বাসন পরিষ্কারের সাবান দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেবেন। ফিডারের নিপলের ছিদ্রটিও ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেবেন।

শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়ায় প্রকট আকার ধারণ করে। আমাদের দেশের অনেক শিশু ডায়রিয়ার আক্রান্ত হয়ে পানিস্বল্পতায় মারা যায়। আমাদের দেশের অপুষ্টির প্রধান কারণ ডায়রিয়া। যদি শিশুর অস্থিরভাব, খিটখিটে মেজাজ বা নিস্তেজ হয়ে যায়, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, শিশুরা তৃষান্ত থাকে বা একেবারেই খেতে পারে না, শিশুর ত্বক টেনে ছেড়ে দিলে তা অনেক সময় পর আগের অবস্থায় ফিরে যায় তাহলে বুঝবেন আপনার শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। শিশুকে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি পান করান। সেই সাথে শিশুর খাবার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বানাতে হবে ও থালা-বাসন ধুতে হবে।

প্রতিবার পায়খানার পর দুই বছরের কম ১০-২০ চামচ, দুই থেকে ১০ বছর ২০-৪০ চামচ ও ১০ বছরের বেশি যতটুকু পারে খাবার স্যালাইন খাওয়ান। একবারেই বেশি স্যালাইন খাওয়াবেন না। ১-২ মিনিট পর পর ১ চামচ করে স্যালাইন দিন। শিশু বমি করলে ১০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করে আবার খেতে দিন। সেই সাথে স্বাভাবিক খাবার দিতে ভুলবেন না। পরিবারে যেসব খাবার রান্না হবে সবই শিশুকে খাওয়ানো যাবে। কাঁচাকলা ডায়রিয়ার তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে। নরম ভাতের সাথে কাঁচাকলা সিদ্ধ বা খিঁচুড়ির সাথে কাঁচাকলা খেতে দিন। তবে চর্বি জাতীয় খাবার কম খাওয়ানো ভাল। ৬ মাসের কম হলে বুকের দুধের সাথে স্যালাইন দিন। সারা দিনে ছয়বারের বেশি খাবার দিন অল্প অল্প করে।

খাবারে তেল দিতে ভুলবেন না। ১৫ দিনের জন্য জিংক ট্যাবলেট খেতে দিন। তবে খুব বেশি পরিমাণে পানির মতো পায়খানা হলে, বার বার বমি হলে স্যালাইন না খেতে পারলে, জ্বর থাকলে, পায়খানার সাথে রক্ত গেলে ও ডায়রিয়ার মেয়াদ ১৪ দিনের বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে ভুলবেন না।

বেশিক্ষণ রান্না করা খাবার বাইরে রেখে দিলে তাতে রোগজীবাণু বৃদ্ধি পায় দ্রুত। গরম গরম খাবার খাবেন। বাড়তি খাবার ঠান্ডা করে রেখে দিন ফ্রিজে। তবে খাওয়ার সময় ভালো করে গরম করে খাবেন।

পাত্রে রাখতে হবে পরিষ্কার পানি। টিউবওয়েলের নিরাপদ পানি কিংবা ফোটানো পানি ঠান্ডা করে পান করুন। চুলায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট পযর্ন্ত পানি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। তবে প্লাস্টিকের বোতলে বা জগ ব্যবহার না করাই ভালো। ফুটানো পানি ঠান্ডা হলে কাচের জার,বোতল বা মাটির কলসে রাখুন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়রিয়া হলে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রথমে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে দিনে আট থেকে ১০ গ্লাস তরল খাবেন। প্রতিবার টয়লেটে যাওয়ার পর এক কাপ পরিমাণে তরল খাবার খাওয়া উচিত।

‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন’-এর তথ্যানুযায়ী ডায়রিয়া হলে উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত খাবার যেমন– কলা, আলু, ফলের রস খাওয়া যাবে। পিনাট বাটার, চমড়াছাড়া মুরগি বা টার্কিও ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

চিকিৎসকের মতে, ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, খাবার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে যারা শিশুদের খাওয়ান, যত্ন নেন, তাদের এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে প্রচুর বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন খেতে হবে। ডায়রিয়ার চিকিৎসায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী তরল ও ইলেকট্রোলাইট প্রতিস্থাপনে ভালো হয়ে যায়, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। ডায়রিয়া প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সচেতনতাই প্রধান। কঠিনভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।

(ঢাকাটাইমস/৮ সেপ্টেম্বর/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :