দুর্নীতি ও দাম্ভিকতার ভিতরেই বাসা বাঁধে ধ্বংসের বীজ
দীর্ঘ সময় ক্ষমতার মসনদে থেকে কয়েকটি বিতর্কিত নির্বাচনের জন্ম দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই দলের ধ্বংস ডেকে এসেছে। এতবড়ো একটি বৃহৎ দলের তলে তলে যে এত গভীর ভাঙন ধরেছে নীতিনীর্ধারকরা তার কোনো খবর পায়নি। আওয়ামী লীগকে এভাবে নাস্তানাবুদ হতে হবে শীর্ষ নেতৃত্ব একটুও আঁচ করতে পারেনি। এখন কী হবে আওয়ামী লীগের! আবার কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে আওয়ামী লীগ? হাটে-ঘাটে, পথে-মাঠে এনিয়ে জনগণের এখন বিস্তর জল্পনা! শেখ হাসিনার বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যক্তি পর্যায় থেকে সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল দুর্নীতির মহোৎসব। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবার নামে সেবাপ্রত্যাশীদের পকেট কেটেছে, প্রতারিত হয়েছে পদে পদে। রাজনৈতিক দলের ছোটো নেতা থেকে বড়ো নেতা সবাই ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, দম্ভ ও অহংকারের কারণে মানুষ ছিল তটস্থ, অসহায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যখন আওয়ামী লীগের নাম কেউ মুখেও নিতে পারেনি সেই একই পরিস্থিতির দেখা মিলছে ২০২৪ সালের আরেক ঠিক ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে। আমার ছোট্টজ্ঞানে যতটুকু বুঝি তৎসময়ে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ট কজনের কারণে বঙ্গবন্ধুর মতো এতবড়ো নেতার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল; ঠিক একই কায়দায় শেখ হাসিনাকেও ধ্বংস করার টার্গেটে নেমেছিল কি না তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। ফিরে দেখা যাক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বগণের কিছু বক্তব্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১শে জুন ২০২৪-এ ঢাকায় এক জনসভায় বলেছিলেন- ‘আওয়ামী লীগ কচুপাতার শিশির বিন্দু নয় যে টোকা দিলে পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগের শিকড় এ দেশের মাটির অনেক গভীরে।’ একটু ধাক্কা লাগলে সরে যাওয়ার পাত্র নয় আওয়ামী লীগ। সদ্য পদত্যাগকারী দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩-এর ১১ই জানুয়ারি এক ভাষণে বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা সহজ নয়। আওয়ামী লীগকে কেউ ধাক্কা দিল আর আওয়ামী লীগ পড়ে গেল, বিষয়টি এত সহজ নয়।’ একই দিনে ঢাকায় অপর আরেকটি সমাবেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন- ‘আওয়ামী লীগ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার দল নয়, বরং যে ধাক্কা দেয় সেই পড়ে যায়। দয়া করে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।’ এই বক্তব্যগুলোর কোনোরকম তাৎপর্য আছে কি না পাঠক হিসেবে আশা করি আপনারা মিলিয়ে নেবেন।
বলা প্রয়োজন যে- চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা নিয়ে দেশের সর্বক্ষেত্রে যে চরম বৈষম্য দেখা দিয়েছিল তার একটি যৌক্তিক সমাধানের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনটি ছিল অত্যন্ত যুক্তিসম্পন্ন। অথচ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলন নিয়ে প্রথমদিকে একটুও মাথা ঘামাতে চাননি। চীন সফরের ওপর প্রেস কনফারেন্স করতে গিয়ে ১৪ই জুলাই শেখ হাসিনা কোটা নিয়ে এক সাংবাদিকের জবাবে যখন বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা কোটা পাবে?’ এরপর আরেকধাপ বাড়িয়ে ১৫ই জুলাই সংবাদসম্মেলনে আন্দোলনের ফুলকিতে ‘ঘি’ ঢেলে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বললেন, ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন রূপ নেয় ব্যাপক সহিংসতায়। শেষ পর্যায়ে আন্দোলন এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকে তার থেকে ফিরে আসা কোনোভাবে সম্ভব ছিল না। আন্দোলনটি বাঁধভাঙা গণঅভ্যুত্থানে মোড় নেয়। তাদের সাথে যোগ দেন অভিভাবক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ। অবশ্য দেরিতে হলেও শেখ হাসিনা ছাত্রদের কোটাসহ সবকটি প্রধান শর্ত মেনে নিয়েছেলেন। ছাত্ররা যখন পুনরায় প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের একদফা দাবিতে ফিরে গেল- অনেকটা বাধ্য হয়ে ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন শেখ হাসিনা। এরপর ছোটো বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে হেলিকপ্টার যোগে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। তিনি দেশ ছাড়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুর্দশা নেমে আসে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী, কারো জানা নেই। ভবিষৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে নিয়েও অনিশ্চিয়তা কাটছে না। এনিয়ে অনেকের প্রশ্ন- আদৌ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে আওয়ামী লীগ? নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না তো আওয়ামী লীগ? জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার দাবি তুলে গত ১৯শে আগস্ট মানবাধিকার সংগঠন সারডা সোসাইটির পক্ষে এক আইনজীবী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। রিটের আবেদনে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে হত্যার দায়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিল এবং বিদেশে পাচারকৃত ১১ লাখ কোটি টাকা ফেরত আনার নির্দেশনা চাওয়া হয়। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে দেশব্যাপী অসংখ্য মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এক কথায় বলা যায়, আওয়ামী লীগ এখন বড়ো বেকায়দায়, কঠিন চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন। দেশের প্রাচীন দল হয়েও আওয়ামী লীগের এই পরিণতি কেন? ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সকলকে একযোগে হত্যা করা হলে তখন আওয়ামী লীগ এরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৯৯ সালের দিকে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও তিনি এখনো অন্তর থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছতে পারেননি। তাই গত ৭ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে নীরবে কেঁদেছিলেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘দেশে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। আমি ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা কোনোমতেই এক কথা নয়। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক; আজ ৩২ নম্বর বাড়ি যেভাবে জ্বলতে পুড়তে, ধ্বংস হতে দেখলাম, তার আগেই আমার মৃত্যু হলে অনেক ভালো হতো।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাবস্থায় অন্যায় করেছে ঠিক, কিন্তু শেখ মুজিব তো কিছু করেননি। তিনি বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেছেন। সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন বাংলা, ৭ই আগস্ট ২০২৪।
চেয়ারে বসে শুধু ওপরের দিকে তাকালে হয় না, নিচের দিকেও তাকাতে হয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেছিল, পুরো আকাশটাই তাদের দখলে কিন্তু আকাশ থেকেও যে তারা খসে পড়তে পারে তারা সেটি ভাবেনি। ক্ষমতার মসনদে তারা এতবেশি মশগুল ছিলেন যে, কারো কথার সামান্যতমও তোয়াক্কা করেননি।
আজকে সত্যকথা বলার লোক সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী নেই। এই আওয়ামী লীগকে শোধরানোর পথ বাতলিয়ে দেবে কে? সত্য কথা বলবে কে? এই সংকটকালে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান স্যারের কথা বেশ মনে পড়ছে। যাঁকে শেখ হাসিনা পিতৃতুল্য মর্যাদা দিতেন। তাঁর উপদেশ পরামর্শ গ্রহণ করতেন, মেনে চলতেন। তিনিও ইহাকাল ছেড়ে চলে গেছেন। প্রফেসর ড. অনুপম সেন স্যার এখনো বেঁচে আছেন। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছেন, তাঁকে এখন অন্যের ওপর ভর করে চলাফেরা করতে হয়। আগের মতো আর লিখতে পারেন না। যাকে বাংলাদেশের মানুষ জ্ঞানের ভান্ডার বলে শ্রদ্ধা সম্মান করেন তিনি আজ আওয়ামী লীগের লেজেগোবরে পরিস্থিতি দেখে বাক্রুদ্ধ! আওয়ামী লীগকে তিনি কী পরামর্শ দেবেন জানি না। যেসব গুণিজন এখনো সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক কথামালা তুলে ধরে অসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছেন- ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, প্রফেসর আনু মুহাম্মদ, লেখক সুলতানা কামাল তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা বর্তমান সময়ের বাস্তবতার নিগূঢ় চিত্র তুলে ধরে তাদের লিখনি চলমান রেখেছেন।
৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন নিঃসঙ্গ, পুড়ে ছারখার ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সেদিন এক সাংবাদিক বন্ধু ফোনে জানালেন পোড়ার খটখটে গন্ধ শুকে ৩২ নম্বর বাড়ি পাড় করতে হচ্ছে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। এ অবস্থা দেখে তার মনে কষ্ট লাগছে। পোড়া ক্ষতের দগ্ধ চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর সেই স্মৃতিমাখা বাড়িটি (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর)। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্নের আগুনে পোড়া দগ্ধ গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে! যেন বাঙালির হৃদয় আগুনের দগ্ধ শিখায় জ্বলছে! এ আগুন কখন নিভবে কেউ জানে না। কিছুদিন আগেও যে বাড়িটি ছিল হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড়ে পূর্ণ, সেই বাড়িটি এখন আলোহীন, নীরব, সিঃসঙ্গ।বিপ্লব বড়ুয়া: কলাম লেখক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক