হাসান মেহেদী-বিহীন দুই মাস
শূন্যতা আর অনিশ্চয়তার হাহাকার
ঢাকা টাইমসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান মেহেদীবিহীন দুই মাস। তরুণ সাংবাদিকের এই অনুপস্থিতি সহকর্মী আর পরিবারের মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ শূন্যতার। দিনের বেশির ভাগ সময় তো এই মানুষগুলোর সঙ্গেই কাটত মেহেদীর। কিন্তু হারানোর বেদনা, সে তো পরিবারের মানুষগুলোর চেয়ে বেশি নয় আর কারও। তার ছোট্ট দুই সোনামণি বাবার স্নেহছোয়া পায় না কত দিন! বাবা নেই, আর আসবে না কোনোদিন, সেটার বুঝ হয়নি তাদের। তাই বাবার অপেক্ষা তাদের প্রতিদিন।
হাসান মেহেদীবিহীন জীবনে স্ত্রী ফারহানা ইসলামের কষ্ট কীভাবে ব্যাখ্যাত হবে? কদিনই বা হলো তার সংসারের যাত্রা। ২০১৮ সালে শুরু মেহেদীর সঙ্গে তার যুগল জীবন। এই ছয় বছরে সংসার আলো করেছে দুই কন্যাসন্তান। একজনের বয়স সাড়ে তিন বছর, অন্য জনের সাত মাস। ছোট্ট মুখের মিষ্টি বুলিতে বাবা ডাক শুনতে ব্যাকুল থাকতেন হাসান মেহেদী। সাত মাসের মেহেরাশ আধো বুলিতে আবু আবু (আব্বু) করত। ছোট্ট এক চিলতে ঘরে বাবা-মেয়ের আদর-আহ্লাদ মুগ্ধ চোখে দেখতেন মা। সুখের এই সময়ে বৈধব্য হানা দিল তরুণী বধূর কপালে। সঙ্গে বয়ে আনে সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। গত দুই মাসে শঙ্কা শুধু নয়, বাস্তবতা এসে হাজির সামনে।
চোখে অন্ধকার দেখছেন হাসান মেহেদীর বাবা-মা। বড় সন্তানের আয়েই যে চলত তাদের ভরণ-পোষণ। ছেলের নিহতের পর বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। তাতে চলে যাচ্ছে এখন। কিন্তু সামনে অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আর সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়ার চিরস্থায়ী বেদনা বুকের ভেতর সারাক্ষণই ঘাঁই দিয়ে যায়। বাবার মন কিছুতেই মানতে পারছে না সোমত্ত ছেলেটি আর নেই। তাকে কেড়ে নিয়েছে পুলিশের গুলি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজলা ঢালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন হাসান মেহেদী। দিনটি ছিল ১৮ জুলাই। স্বৈরাচার হটানোর এই আন্দোলনে প্রথম শহীদ সাংবাদিক। দেশের ইতিহাসে কোনো আন্দোলনে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের গুলিতে সাংবাদিক হত্যার ঘটনাও প্রথম। এরপর ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে আরও চারজন সাংবাদিক মারা গেছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে।
হাসান মেহেদী ঢাকাটাইমস ডিজিটালের ভিডিও কনটেন্টও বানাতেন, মাঝে মাঝে নিজে ভয়েস দিতেন তিনি। বেশ ভরাট কণ্ঠ। ১৭ জুলাই রাতে ‘শান্তি নাকি নতুন পরিস্থিতির অপেক্ষা’ টাইটেলের একটি ভিডিও কনটেন্টে ভয়েস দেন হাসান মেহেদী। পরদিন নতুন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়ায় বাংলাদেশ, তার বলি হয় তরুণ সাংবাদিক মেহেদী হাসান, অনিশ্চিত ভবিতব্যে সমর্পিত হয় তার স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনরা। আর প্রিয় সহকর্মী হারানোর বেদনায় নীল হয় ঢাকা টাইমস।
ঢাকা টাইমসের দুদক বিটের সাংবাদিক হাসান মেহেদী ওই দিন সকাল থেকে দুদকে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকেই বিকেলের দিকে ছুটে যান যাত্রাবাড়ী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের তুমুল সংঘর্ষ চলছে সেখানে। একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় হাসান মেহেদী তখন পুলিশের আশপাশে থেকে ভিডিও ধারণ করছিলেন।
একজন সাংবাদিক জানান, হাসান মেহেদি ফ্লাইওভারের ওপর থেকে নিচের লোকজনকে বলছিলেন, ওপরে একটা লাশ পড়ে আছে। এ নিয়ে একাধিক পুলিশ তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঘটনাস্থলে। এর মিনিট দশেকের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন হাসান মেহেদী।
হাসান মেহেদীকে প্রথম উদ্ধার করেন মো. ইয়াছিন আহমেদ নামের একজন শিক্ষার্থী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছাত্র আর পুলিশ দফায় দফায় জায়গাটির দখল নেওয়ার চেষ্টা করছিল। পুলিশ সামনে এগিয়ে গুলি করে আবার একটু পেছনে সরে গিয়ে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে সেখানে একজনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি আমরা। সেই মরদেহ আনতে গিয়ে দেখি সামনে আরেকজন পড়ে আছে। তার গলায় সাংবাদিক পরিচয়পত্র ঝোলানো।’
হাসান মেহেদী হয়তো এই লাশের কথাই বলছিলেন। মানবিক এই কর্তব্যবোধের দায় তাকে দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে। পুলিশের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যায় বুক, গলায় গভীর ক্ষত, বাহু আর মুখে কয়েক ডজন ছররা গুলি, মাথায়ও অগণন। হাসান মেহেদীর মৃত্যু সনদে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক লিখেন ‘গান শট ইনজুরি।
প্রথম উদ্ধারকারী ইয়াছিন সংবাদমাধ্যমকে জানান, তারা হাসান মেহেদীর মোবাইল ফোনটি আনলক অবস্থায় পান। হাছান মেহেদী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হয়তো পরিবারকে ফোন দিতে চেয়েছিলেন। জানাতে চেয়েছিলেন তার অবস্থা। কিন্তু পারেননি। উদ্ধারকারী ইয়াছিন কললিস্ট দেখে ফোন দেন পরিবারকে।
কথা ছিল অফিস শেষে বাসায় ফিরে যাবেন হাসান মেহেদী। সেই অপেক্ষায় ছিল ছোট্ট নিশা-অনিশা আর স্ত্রী ফারহানা। হাসান মেহেদী বাসায় ফেরেননি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাবার লাশ নিয়ে বাউফলে গ্রামের বাড়িতে যায় নিশা-অনিশা। সেখানে বাড়ির উঠানে দাফন হয় তরুণ সাংবাদিকের।
ঘর থেকেই দেখা যায় হাসান মেহেদীর কবর। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সবাইকে দেখে রাখতেন মেহেদী। ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে বাড়ি যেতেন। মা তখন ব্যতিব্যস্ত হতেন ছেলের পছন্দের খাবার আয়োজনে। এখন মাঝে মাঝে আসতে হয় না ছেলেকে, সবার চোখের সামনে চিরশয্যায় নিস্তব্ধ শুয়ে আছেন উঠানে। সারা দিন নির্বাক চেয়ে চেয়ে দেখেন ছেলের কবর। আর বারবার ঝাপসা হয়ে আসে তাদের চোখ।
মেহেদীর পরিবার, বন্ধু-স্বজন আর সাংবাদিক সমাজ যখন শোকাচ্ছন্ন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার ও তার পুলিশ বাহিনী মেহেদী হত্যার দায় চাপায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর। সেখানেই থেমে থাকেনি তারা, যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করে তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
মেহেদি হত্যার ১৭ দিন পর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ‘পুলিশের গুলিতে কোনো সাংবাদিক মারা যায়নি।’এমনকি তিনি এও বলেন, ‘আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কেউ মারা যায়নি।’