কিডনি সুস্থ রাখে ভেষজ মহৌষধি কদবেল

দেশীয় ফলের মধ্যে কদবেল সবার কাছে বেশ পরিচিত। মৌসুমি ফল হিসাবে কদবেলের জুড়ি মেলা ভার। পথেঘাটে কদবেলের পসরা হরহামেশাই চোখে পড়ে। শক্ত খোলসে আবৃত টক মিষ্টি স্বাদের দেশীয় ফল কদবেল। টক স্বাদের মৌসুমি এই ফলটি জ্যাম এবং চাটনি তৈরির জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। আমের চেয়ে সাড়ে ৩ গুণ, কাঁঠালের দ্বিগুণ, আর আমলকী ও আনারসের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি পরিমাণ আমিষ রয়েছে ফলটিতে। কদবেল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম লিমোনিয়া অ্যাসিডিসিমা। এটি রুটেসি গোত্রের উদ্ভিদ। এদের আদি নিবাস ভারত (আন্দামান দ্বীপপুঞ্জসহ), বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে এই প্রজাতিটির চাষ ইন্দোচীন এবং মালয়েশিয়ায়ও দেখা যায়। ইংরেজিতে কদবেলকে Elephant Apple বা Monkey fruit নামে ডাকা হয়।
বিভিন্ন জৈব অ্যাসিডে ভরপুর ফল কদবেল। এতে ডায়রিয়া প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কদবেলের অপরিপক্ক ফল অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করা বন্ধ করতে পারে। আয়ুর্বেদ এবং লোকজ ওষুধ বহু শতাব্দী ধরে ডায়রিয়ার জন্য কদবেল ব্যবহার করে আসছে। এর ভেতরের রাসায়নিক উপাদান রাইবোফ্লাভিন এবং থায়ামিন শরীরকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এর রস কিডনির রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং অন্ত্রকে সুস্থ রাখে। উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ কদবেল কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বদহজমের জন্য উপকারী।
বর্ষার শেষে যখন অন্য কোন ফল বাজারে পাওয়া যায় না তখন এই ফল দেখা যায়। পাকা কদবেলের খুব সুন্দর ঘ্রাণ বিদ্যমান। পাকা ফল ফাটিয়ে অথবা ছিদ্র করে কাঠি দিয়ে এ ফলের শাঁস কেতে হয় । কাঁচা শাঁসের রঙ হালকা বাদামি-ঘিয়ে, মিষ্টি-টক। কিন্তু পাকলে গাঢ় চকোলেট বা পীতাভ বাদামি হয়ে যায়, কালচে বাদামিও হয়। পাকলে শাঁস নরম হয়, চটকালে মাখনের মতো হয়ে যায়। শাঁসের ভেতর থাকে ছোট ছোট অনেক হালকা বাদামি রঙের বীজ। বীজ থেকে সহজে চারা হয়। যদি টবে রোপণ করতে চান তাহলে কলমের চারা উপযোগী। কলমের চারা থেকে দুই তিন বছরের মধ্যে ফুল-ফল ধরে।
কদবেল গাছ ১২ মিটার থেকে ১৫ মিটার উঁচু হয়। কাঠ শক্ত ও পাতা ঝরা বৃক্ষ। গাছের পাতা কামিনি ফুলের পাতার মতো। গাছের ফল টেনিস বলের মতো গোলআকার। ২-৫ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট সাদা ধূসর বর্ণের শক্ত বেলের মতো খসখসে। খোলসের ভিতর শাঁস থাকে। এই শাঁস খাওয়া হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ফলপাকে।
ফলের শাঁসে থাকে প্রচুর পরিমাণে সাইট্রিক এসিড, মিউসিলেজ ও খনিজ পদার্থ। পাতায় থাকে স্টিগমাস্টেয়ল, সোরালেন, অরিয়েনটিন, ট্যানিন, স্যাপো-নারিন প্রভৃতি। বীজে থাকে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, অ্যামাইনো এসিড। মূলে থাকে ফেরোনিয়াল্যাকাটোন, বীরগ্যাপটেন, অমথল মারমেসিন এবং মারমিন প্রভূতি উপাদান।
কদবেলে প্রচুর পরিমাণে আমিষ বা প্রোটিন ও ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম পাওয়া যা আমাদের শরীরের সুস্থতার জন্য খুবই দরকার। পুষ্টিবিধদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী কদবেলের পুষ্টিমান নিম্নরূপঃ জলীয় অংশ ৮৫.৬ গ্রাম, খাদ্য শক্তি ৪৯ কিলোক্যালরি, আমিষ ৩.৫ গ্রাম, চর্বি ০.৩ গ্রাম, শর্করা ৮.৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮৫ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৬ মিরিগ্রাম, ভিটামিন সি ৬০ মিলিগ্রাম, শর্করা ৩১.৮ গ্রাম, নিয়াসিন ১.২ মিলিগ্রাম, ১.২০ মিলিগ্রাম বিবোফ্লোভিন, ০.১৩ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ভিটামিন এ ৫৫ মিলিগ্রাম, আঁশ৫ গ্রাম, ৫০ মিলিগ্রাম ফসফরাস ভিটামিন ই ০.৮০ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়।
কদবেলের খনিজ উপাদান ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। ডায়াবেটিসের আয়ুর্বেদী চিকিৎসায় কদবেল ব্যবহার হয়। কদবেল রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। গুড় বা মিছরির সঙ্গে কদবেল মিশিয়ে খেলে শরীরের শক্তি বাড়ে এবং রক্তস্বল্পতা দূর হয়। এছাড়া কদবেল কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ভিটামিন সি’ এর ভালো উৎস বিধায় স্কার্ভি প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কদবেলের ট্যানিন নামক উপাদান দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া ও পেট ব্যথা ভালো করতে সাহায্য করে। কদবেলে রয়েছে ট্যানিন, যা অন্ত্রের কৃমি ধ্বংস করে। কদবেল পাতার রস পানির সঙ্গে নিয়মিত পান করলে পেপটিক আলসার দ্রুত ভালো হয়। আলসারের ক্ষত সারাতে তাজা কদবেল বেশ কার্যকরী। কদবেল মৌসুমী জ্বর, ঠান্ডা, কাঁশি, পেটের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। খাবারে রুচি বাড়ায় এবং হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। কদবেল লিভার ও হার্টের জন্য বেশ উপকারী। কদবেল পেটের আলসার নিরাময়ে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া কদবেল আরো যে রোগ নিরাময়ে প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে কাজ করে তা হলোঃ
কিডনি সুস্থ রাখে
কদবেল ফলটি মূত্রবর্ধক ও উদ্দীপক। এই ফল শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম বের করতে সহায়তা করে। কিডনিতে ১০ লক্ষ করে প্রায় ২০ লক্ষ নেফ্রন থাকে যা ছাকনির কাজ করে। কদবেলের উপাদান গুলো কিডনি বা বৃক্কের কাজ সুষ্ঠভাবে করার জন্য খুবই সাহায্য করে। ফলে কিডনি পরিষ্কার থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে কিডনি, যকৃত ও লিভারে দোষ ত্রুটি দূর করতে কদবেল প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে কাজ করে। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা বিদ্যায় কিডনি সমস্যা দূর করার জন্য সেরা প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো কদবেল।
শক্তি যোগায়
গরমকালে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কদবেল খেলে তাৎক্ষণিকভাবে শক্তি যোগায়। এতে থাকা শর্করা ও প্রাকৃতিক শর্করা শরীরকে পুনরায় উদ্দীপ্ত করে। কদবেল শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্নায়ুর শক্তি যোগায়। তাই কদবেল খেলে গরম কম লাগে। ত্বকের জ্বালা পোড়া কমাতে কদবেল মলম হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ব্রণ ও মেছতায় কাঁচা কদবেলের রস মুখে মাখলে বেশ দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
কদবেলের খনিজ উপাদান ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। কদবেলে গ্লাইকেমিক ইনডেক্স কম থাকায় এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিসের আয়ূর্বেদী চিকিৎসায় কদবেল ব্যবহার হয়।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
কদবেলে এমন সব উপাদান রয়েছে যা সবগুলো মিশে মহিলাদের হরমোনের অভাব সংক্রান্ত সমস্যা কমিয়ে দেয়। যৌন হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। বিশেষ করে স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
শ্বাসযন্ত্রের রোগ প্রতিরোধে
পাতার রস শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগ নিবারণে সাহায্য করে। গলায় চুলকালে, গলায় ঘা হলে, ঘন ঘন হেঁচকি উঠলে কদবেল খেলে খুবই উপকার পাওয়া যায়। নিয়মিত কদবেল খেলে ফুসফুস পরিষ্কার হয়। হাঁপানী সমস্যা দেখা দিলে কদবেল খেলে উপকার পাওয়া যায়।
পেটের রোগ নিরাময়ে
কদবেলে ট্যানিন নামক উপাদান থাকে যা ঘন ঘন ডায়রিয়া ও পেট ব্যথা দূর করে। এছাড়া কাঁচা কদবেল, এলাচ ২/৩ টা গোলমরিচ ও মধু মিশিয়ে খেলে পেটের বদ হজম কমে যায় এবং পেট পরিষ্কার হয়। আমাশয় রোগেও কাজ করে। কদবেলের শাঁস ভিজিয়ে রেখে বা নির্যাস শরবত হিসেবে খেলে কলেরা ও অর্শ্ব রোগে খুবই উপকার পাওয়া যায়।
রক্ত স্বল্পতা দূর করে
পাকা কদবেলে শাঁস নিয়মিত কয়েকদিন খেলে দেহে হিমগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ে এবং রক্ত তৈরী হয়। ফলে দেহে রক্ত স্বল্পতা দূর হর। রক্তের দোষ ত্রুটি কমে রক্ত পরিষ্কার হয়। কদবেলের পুষ্টি উপাদান গুলো লো প্রেসার বা নিম্নরক্তচাপ নিরাময়ে সাহায্য করে। রক্ত স্বল্পতার জন্য খুবই বেশি পরিশ্রান্ত লাগা বা হাঁপিয়ে ওঠা বুকের ধড়ফড় হলে তা দূর হয়।
হাঁপানির বিরুদ্ধে কার্যকর
হাঁপানির উপসর্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য কদবেল পাতার নির্যাসের আয়ুর্বেদিক ব্যবহার আছে। মধুর সাথে ৮ থেকে ১৬ গ্রাম তাজা কদবেল পাতার নির্যাস হাঁপানির বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
কদবেলে প্রচুর আঁশ আছে। শক্ত পায়খানাকে নরম করে দেহ থেকে বের করে দিয়ে পেট পরিষ্কার করে। তাছাড়া কদবেল ফুল শুকিয়ে পাউডার করে বোতলে ভরে রাখুন সারা বছরই খেতে পারবেন। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য ও পুরাতন আমাশয় নিরাময় হয়।
আলসার নিরাময়ে
কদবেল পেটের যে রোগের প্রতিষেধক পেটে পেপটিক আলসার বা ক্ষত হয়ে গেলে পাকা কদবেলে শাঁস খান আলসার ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসবে মুখের রুচি ও বাড়বে। তাছাড়া কঁচি কদবেলের পাতার রস পানির সাথে মিশিয়ে খেলে পেপটিক আলসার কমে আছে। পায়খানাও পরিষ্কার হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
কদবেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে যা একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই শক্তিশালী করে তোলে। তাছাড়া আমাদের শরীরের চামড়াকে বুড়িয়ে যেতে দেয় না তারুণ্যকে ধরে রাখে।
মুখের ব্রুন ও মেছতা নিরাময়ে
মুখে ব্রুন বের হলে খুড়াখুড়ি না করে কচি কদবেলের রস ব্রুনের উপর লাগালে ব্রুন ভালো হয় এবং দাগও দূর হয়। আর যাদের মেছতা আছে তারা কাঁচা কচি কদবেলের রস মেছতার ওপর নিয়মিত ৪/৫ দিন লাগান মেছতার দাগ দূর হবে। তবে মনে রাখবেন প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি খাবেন।
হাঁড় মজবুত করে
কদবেলে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে। যা দেহের হাঁড় ও দাঁতের গঠন পরিপক্ক করে দেহকে সুস্থ্য রাখে। হাঁড়ের জোড়ার মাঝে থাকা মিউকাস পরিপুষ্ট করে। ফলে ওঠাবসার সমস্যা নিরাময় করে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
কদবেল ফল উচ্চ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এর পাতার গুঁড়া অপরিশোধিত ফাইবারের একটি সমৃদ্ধ উৎস।
লিভারের জন্য ভালো
কদবেলের মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ লিভারের জন্য উপকারী। কদবেল লিভারের কর্মক্ষমতা উন্নত করে এবং লিভারের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে।
(ঢাকাটাইমস/২৮ সেপ্টেম্বর/আরজেড)

মন্তব্য করুন