বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ৩২টি বড় বিমান দুর্ঘটনা: উত্তরায় নতুন ভয়াবহ সংযোজন

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসে প্রশিক্ষণ চলাকালে দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩২টি বড় দুর্ঘটনার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যার বেশিরভাগই ঘটেছে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট চলাকালীন। এসব দুর্ঘটনায় ফ্লাইট ক্যাডেট, স্কোয়াড্রন লিডারসহ অনেক কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছেন।
’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সে সময় এক দিনেই ৪৪টি বিমান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। তবে সোমবার (২১ জুলাই) ঢাকার উত্তরায় একটি স্কুল ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উত্তরার গতকালের দুর্ঘটনা এ তালিকায় বিরল ও ভয়াবহ সংযোজন। যেখানে যুদ্ধবিমান সরাসরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। বিমানবাহিনীর এর আগের বেশির ভাগ দুর্ঘটনা প্রশিক্ষণ চলাকালেই ঘটে, যা পিটি-৬, ইয়াক-১৩০, এল-৩৯ বা এফ-৭ টাইপ বিমানের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেছে। প্রায় প্রতি দশকেই ফ্লাইট ক্যাডেট এবং স্কোয়াড্রন লিডারদের প্রাণহানি ঘটেছে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৯৯১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সব বিমান দুর্ঘটনার তালিকা তুলে ধরা হলো।
২০২৫ সালের ২১ জুলাই এফ-৭ বিজিআই উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হয় ৩১ জন শিক্ষার্থী যার মধ্যে ২৫ জনই শিশু। আহত হয়েছে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। নিহত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর।
২০২৪ সালের ৯ মে ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিধ্বস্ত হয়। নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ।
২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমান টাঙ্গাইলে রকেট ফায়ারিং অনুশীলনের সময় বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট নিহত হন। একই সালের ১ জুলাই কে-৮ ডব্লিউ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুই পাইলট প্রাণ হারান এবং ২ জানুয়ারি মিল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিধ্বস্ত হয়ে কুয়েতি সামরিক কর্মকর্তাসহ নিহত হন একাধিক ব্যক্তি।
২০১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর দুটি ইয়াক-১৩০ কক্সবাজারে বিধ্বস্ত হয়। একই সালের ১১ জুলাই ইয়াক-১৩০ চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় বিধ্বস্ত হয়।
২০১৫ সালের ২১ জুলাই এমআই-১৭১এসএইচ হেলিকপ্টার মিরসরাইয়ে জরুরি অবতরণকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সালের ২৯ জুন এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান পতেঙ্গা উপকূলে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিহত হন এবং ১৩ মে এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। প্রাণ হারান এক প্রশিক্ষক।
২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। একই সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আরেকটি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়।
২০১৩ সালের ২০ মে এল-৩৯ প্রশিক্ষণ বিমান যশোরে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে। একই সালের ১৪ জুলাই ন্যাঞ্ছাং এ-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়।
২০১২ সালের ৮ এপ্রিল এল-৩৯ অ্যালবাট্রস জেট ট্রেনার, মধুপুরে বিধ্বস্ত হয়। প্রাণ হারান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা শরীফ।
২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বরিশালে বিধ্বস্ত হয়ে দুই স্কোয়াড্রন লিডার নিহত হন। একই সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত হয়।
২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর পিটি-৬ ট্রেনার বিমান বগুড়া সদরে বিধ্বস্ত হয়। একই সালের ১৬ জুন এফটি-৬ যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত হয়।
২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান টাঙ্গাইলের পাহাড়িয়া গ্রামে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ।
২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান যশোরে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হন ফ্লাইট ক্যাডেট ফয়সাল মাহমুদ।
২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল পিটি-৬ ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হন ফ্লাইট ক্যাডেট তানজুল ইসলাম।
২০০৫ সালের ৭ জুন এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমানের উত্তরায় বহুতল ভবনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ২০০৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়।
২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর পাইপার সেসনা এস-২ বিমান বিধ্বস্ত হয়। একই সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিধ্বস্ত হয় এফটি-৭বি বিমান।
২০০২ সালের ১৯ অক্টোবর এমআই-১৭-২০০ হেলিকপ্টার কক্সবাজার উখিয়ায় বিধ্বস্ত হয়। প্রাণ হারান চারজন। ২০০২ সালের ৩০ জুলাই এ-৫সি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত হয়। প্রাণ হারান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আদনান।
২০০১ সালের ৭ জানুয়ারি এফটি-৭বি ট্রেনার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ মহসিন।
১৯৯৮ সালের ১৭ নভেম্বর ন্যাঞ্ছাং এ-৫সি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। একই সালের ২৬ অক্টোবর বিধ্বস্ত হয় এফ-৭এমবি।
১৯৯৬ সালের ৮ মে একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়।
১৯৯৪ সালে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ যুদ্ধবিমান।
১৯৯৩ সালে দুটি পিটি-৬ ট্রেনিং বিমানের সংঘর্ষ হয়। প্রাণ হারান তিন পাইলট। ১৯৯৩ সালে একটি এফটি-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কুদ্দুস নিহত হন।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৪০টি এফ-৬ এবং ৪টি মিল-৮ হেলিকপ্টার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রশিক্ষণ বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি, পুরনো মডেলের ইঞ্জিন, পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও কড়া আবহাওয়ার ঝুঁকি এসব দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে পিটি-৬ এবং এল-৩৯ মডেলের বিমানে নিয়মিতভাবে যান্ত্রিক ত্রুটির অভিযোগ উঠেছে।
উত্তরার ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ফ্লাইট রেকর্ডার সংগ্রহ করা হয়েছে এবং বিমানটির ওড়ার সময়কাল, রুট ও কারিগরি অবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট আরও নিরাপদভাবে পরিচালনার জন্য নির্দেশনা জারি করা হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইটের সময় পর্যালোচনা করা হবে।
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা একটি সতর্কবার্তা, যে শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রমই নয়, বরং তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও জরুরি। জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইটের পূর্ব সতর্কতা, নদী-সাগর এলাকায় নিরাপদ রুট নির্ধারণ এবং আধুনিক প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।
(ঢাকাটাইমস/২২ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন